E-Paper

‘লক্ষ্মণরেখা’

রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতা প্রয়োগ করে, লোভ দেখিয়ে আর ভয় দেখিয়ে হয়তো চটজলদি সমর্থন আদায়ের পথ সহজ। কিন্তু তাতে নাগরিকের সঙ্গে নির্বাচিত সরকারের দূরত্ব ক্রমশ বাড়ে।

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০২৫ ০৬:০৪

লক্ষ্মণরেখার মধ্যে থেকে আন্দোলন করতে হবে, চাকরিহারা শিক্ষকদের বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাল্টা প্রশ্ন করা যেতেই পারে: গণতন্ত্রে সরকারেরও কি ‘লক্ষ্মণরেখা’ মেনে চলার কথা নয়? তেমন লক্ষ্মণরেখা একটি তো নয়— সত্য আর মিথ্যা, কৌশল আর কারসাজি, প্রতিরোধ আর প্রতিশোধ— জনবিক্ষোভের সামনে এমন নানা সীমানা মূর্ত হয়ে ওঠে। ক্ষমতাসীন সরকার তখন কোন পক্ষটি বেছে নেয়, সেটাই নির্ধারণ করে দেয় তার অবস্থান। মমতা শিক্ষকদের আন্দোলনে ‘বহিরাগত’দের উপস্থিতির যে অভিযোগ করলেন, এই আন্দোলনের নেপথ্যে ‘রাজনৈতিক উস্কানি’-র যে তত্ত্ব সামনে আনলেন, সেগুলি আন্দোলনকারীদের সততা, এবং আন্দোলনের গুরুত্বকে খর্ব করতে চাইছে। নির্দিষ্ট তথ্য না থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ কি প্রশাসনের নৈতিকতার সীমা লঙ্ঘন করে না? প্রশাসনিক দুর্নীতি ও বেনিয়মের জন্য যে বিপুল অবমাননা, ক্ষতি এবং অনিশ্চয়তার মুখে এই শিক্ষকরা পড়েছেন, তাতে তাঁদের আন্দোলনের ভঙ্গির কিছু জঙ্গিপনা নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠেও, তাঁদের দাবিগুলিকে অসঙ্গত বলা চলে না। অথচ, কোনও বিশেষ প্রমাণ ছাড়াই তাঁদের আন্দোলনকে নিছক ‘রাজনৈতিক বিরোধিতা’ বলে চিহ্নিত করছেন মুখ্যমন্ত্রী। এতে কি শিক্ষকদের মর্যাদা লঙ্ঘিত হচ্ছে না? এবং, এত বড় বেনিয়মের ক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক বিরোধিতা’ হবে— গণতন্ত্রের এই প্রাথমিক শর্তটিও কি মুখ্যমন্ত্রী স্বীকার করেন না?

রাজ্যবাসীর অভিজ্ঞতা, ইতিপূর্বেও নানা বিষয়ে যাঁরা সরকারের স্বচ্ছতা, সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, অথবা সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন, তাঁদের প্রতিবাদকে প্রশাসনিকতার পরিসর থেকে নিছক রাজনৈতিক বিরোধিতার পরিসরে নামিয়ে আনার একটি অভ্যাস তৈরি করে ফেলেছে তৃণমূল সরকার। কামদুনি থেকে শিক্ষক-আন্দোলন, এই দীর্ঘ পথে বার বার নাগরিক পরিসরের সীমাকে নস্যাৎ করে তাকে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চেয়েছেন শাসকরা। যা নাগরিকের অধিকার আদায়ের আন্দোলন, ন্যায়বিচারের জন্য আন্দোলন, তাকেও স্বার্থ-সঙ্কীর্ণ, ক্ষমতালোলুপ বিরোধীর অক্ষম চেষ্টা বলে দেখিয়ে দেওয়া। দলীয় রাজনীতির ধর্মই এই যে, তা যে কোনও বিরোধিতাকে খর্ব করে, দুর্বল করে, তাকে নিজের প্রতি আকর্ষণের চেষ্টা করে। তাতে সমস্যা নেই, কিন্তু তা করতে হবে রাজনৈতিক উপায়ে, রাজনীতির কৌশলে। বিরূপ, বিভ্রান্ত, হতোদ্যম মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা-ভরসার সঞ্চার করে, সংগঠিত রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার নিদর্শন তো এ দেশে, এ রাজ্যে, কম নেই। কিন্তু তার জন্য দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম, পরিকল্পনা, জনসংযোগের প্রয়োজন।

রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতা প্রয়োগ করে, লোভ দেখিয়ে আর ভয় দেখিয়ে হয়তো চটজলদি সমর্থন আদায়ের পথ সহজ। কিন্তু তাতে নাগরিকের সঙ্গে নির্বাচিত সরকারের দূরত্ব ক্রমশ বাড়ে। প্রতিবাদীর উপর কঠোর মামলা দিয়ে, পুলিশি হয়রানিতে নাকাল করা, প্রতিবাদের ‘মুখ’ মানুষগুলিকে বেছে বেছে হেনস্থা করা, এই কি গণতন্ত্রে রাজনীতির কৌশল? আজ ভারতে রাষ্ট্রশক্তি প্রতিবাদীকে চুপ করিয়ে দেওয়াকে ‘স্বাভাবিক’ করে তুলেছে। গণতন্ত্রের লক্ষ্মণরেখা বারে বারেই স্পর্শ করছে স্বৈরাচারের পরিধিকে। পশ্চিমবঙ্গও ব্যতিক্রম নয়। আর জি কর-কাণ্ডে, শিক্ষক নিয়োগ কাণ্ডে দুর্নীতি, ব্যর্থতার বিষয়ে নাগরিকের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদের উপর দোষারোপ করছেন, নাগরিকের থেকে প্রশ্নহীন আনুগত্যের দাবি করছেন। শিক্ষকদের আন্দোলন সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, দাবি করেছেন তিনি। অথচ, বিকাশ ভবনের সামনে নির্বিচারে লাঠি-লাথি চালিয়ে পুলিশ সে দিন লক্ষ্মণরেখা ছাড়িয়েছিল কি না, তার উত্তর দেননি। গণতন্ত্রে সরকার যদি আপন সীমা মেনে না চলে, তবে গণতান্ত্রিক পালিকা-শক্তি ক্রমশ পরিণত হয় স্বৈরাচারী পীড়ন-শক্তিতে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Protest Bikash Bhavan Mamata Banerjee

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy