E-Paper

বাক্যের শক্তি

বিপরীতে রয়েছে সংলাপহীনতা— জীবনসঙ্গী, সন্তান, বন্ধুদের সঙ্গে। কেউই নিজের মনের কথা অপরকে বলতে পারে না, হয় সঙ্কোচে, নয় আঘাতের ভয়ে।

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২৫ ০৬:৪৬
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

বাক্যই মানুষকে আবদ্ধ করে, বাক্যই মুক্ত করে। তাই বাক্যের বিবিধ প্রকার কী তা আমাকে বলুন, পার্বতী বলেছিলেন মহেশ্বরকে। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বাক্যের ভালমন্দ নিয়ে কথা বলছেন শিব-পার্বতী। যারা স্বর্গে যাওয়ার অধিকারী, তারা কেমন কথা বলে, আর কী ধরনের কথা বলা থেকে নিজেদের বিরত রাখে, সে কথা পার্বতীকে বলছেন মহেশ্বর। সে বিবরণ পড়লে আজ বিস্ময় জাগে এই ভেবে যে, পাপ-পুণ্যের বিচারে কাজের সমান গুরুত্ব পাচ্ছে মুখের কথা। হত্যাকারী বা পরসম্পদ লুণ্ঠনকারী যেমন স্বর্গে যেতে পারে না, তেমনই যেতে পারে না রুক্ষ, নিষ্ঠুর বাক্যের উচ্চারণকারীও। গৌতম বুদ্ধ স্বর্গ মানতেন না, কিন্তু তিনিও দুঃখমুক্তির অষ্টমার্গের মধ্যে রেখেছিলেন ‘সম্যক বাক’— যে বাক্য সত্য, অপরকে আঘাত করে না, বিভেদ তৈরি করে না, এবং যা কেবল বৃথা আলাপ নয়। আর মহাভারতে মহেশ্বর বলছেন, পরের কুৎসাসূচক বাক্য যাঁরা বলেন, বাক্যের দ্বারা যাঁরা বন্ধুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেন, তাঁরা কেউ স্বর্গের অধিকারী নন। স্বর্গের জন্য হয়তো আজ তত আগ্রহ নেই— অপ্সরাদের নাচ দেখে, পারিজাত শুঁকে, সোমরস খেয়ে কত আর দিন কাটানো যায়! কিন্তু মনুষ্যত্বের ‘নোবেল প্রাইজ়’ বলতে যে-হেতু স্বর্গই বুঝে এসেছে কয়েক হাজার প্রজন্ম, তাই আজও স্বর্গপ্রাপ্তিকে ধরেই শুরু করতে হয় মানবজীবনের শ্রেয়-প্রেয়র খোঁজ। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ধর্মশাস্ত্রে, নীতিশাস্ত্রের অন্যতম প্রশ্ন, ‘ভাল কথা’ বলতে কী বুঝব? কেমন কথা বলা উচিত? আজ এ প্রশ্ন যেন এলেবেলে। অষ্টপ্রহর সম্প্রচার হয় নেতাদের তর্জন-গর্জন, যার পনেরো আনাই বিরোধীকে অপমান, তাচ্ছিল্য, আঘাত। এমনকি সংবাদের ভাষ্যও হয়ে দাঁড়িয়েছে বাগ্‌যুদ্ধ— উচ্চকণ্ঠে অপরকে নস্যাৎ করার খেলা। এর প্রভাব এমন বেড়েছে যে মানুষে-মানুষে শিষ্টালাপ প্রায় কোণঠাসা। অতি সামান্য কারণে উত্তপ্ত, ক্ষিপ্ত কথার ব্যবহার এখন ঘরে-ঘরে, পাড়ায়-পাড়ায়, এমনকি স্কুলে-স্কুলে ঘটে চলেছে।

এর বিপরীতে রয়েছে সংলাপহীনতা— জীবনসঙ্গী, সন্তান, বন্ধুদের সঙ্গে। কেউই নিজের মনের কথা অপরকে বলতে পারে না, হয় সঙ্কোচে, নয় আঘাতের ভয়ে। মোবাইল ফোন কিংবা টিভিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দিন কাটে। শেষে ছুটতে হয় মনোরোগ-বিশেষজ্ঞের কাছে। কিন্তু সঙ্কট কি সত্যিই মনের, না কি মনের ভাব প্রকাশ করে যে ভাষা, তার ব্যবহারে? মানুষে-মানুষে সংযোগের চিরকেলে পথ কী করে বন্ধ হয়ে গেল? আসলে ভাষার শিক্ষা তো কেবল বাক্যগঠনের শিক্ষা নয়, তা একে-অন্যের প্রতি আচরণের পাঠ। উদ্ধত, অসহিষ্ণু বাক্য কী করে সম্পর্ক গড়ে তুলবে? অপরকে রূঢ় কথা শুনিয়ে অনেকে আস্ফালন করেন, সত্য কথা অপ্রিয়ই হয়। অপ্রিয় হলেও সত্য বলতে হবে বইকি— সব ধর্মেই সত্যের মূল্য সবার উপরে। আধুনিক কালে গান্ধীও বলেছেন, ঈশ্বর সত্য, এমন বলার থেকে বরং বলা উচিত, সত্যই ঈশ্বর। কিন্তু সত্যেরএই ধারণার মধ্যে রয়েছে অপরের হিত, সকলের কল্যাণের ধারণাও। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, বাক্যের দ্বারা হিংসার মধ্যে রয়েছে অপরের কুৎসা কথন (অসৎ প্রলাপ), নিষ্ঠুর বাক্য (পারুষ্য), অপরের দোষসূচক বাক্য (পৈশুন্য) আর মিথ্যাকথন (অনৃত)। সত্য কথাও এমন ভাবে বলতে হবে, যা অপরকে আঘাত করবে না।

মহাভারতের শান্তিপর্বে বলা হচ্ছে, বাক্যবাণে আহত ব্যক্তি দিবারাত্রি শোক করে। বাক্যের আঘাত যেমন তীব্র ক্ষত তৈরি করে, তা কোনও ধারালো অস্ত্রও করতে পারে না। দেহ বিদ্ধ নানা অস্ত্র তুলে ফেলা যায়, বাক্যের শল্য তোলা যায় না। কুঠারে ছিন্ন বৃক্ষ আবার উৎপন্ন হয়, বাক্যবিদ্ধ মন আর জেগে ওঠে না। এ যে কত বড় সত্য, নিজের অন্তর দিয়ে তা কে না বুঝেছে? বিশেষত শিশুদের মনে অভিভাবক বা শিক্ষকদের বিদ্রুপবাক্য এমন গেঁথে যায়, যা থেকে রক্তপাত হয় সারা জীবন। জীবনে অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েও সে বেদনা ভুলতে পারে না। কেন তিরস্কারকে হতেই হবে বাক্যের বেত্রাঘাত? মধ্যযুগের সন্ত টমাস একুইনাসের সঙ্গে পরিহাস করে দুই সাধু বলেছিল, “দেখো, দেখো, শুয়োর উড়ে যাচ্ছে।” টমাস অমনি জানলায় ছুটে গিয়ে দেখতে লাগলেন। সাধুরা তাই দেখে হাসিতে ফেটে পড়ল। টমাস তখন তাদের বলেছিলেন, “আমি বরং বিশ্বাস করতে পারি যে শুয়োর উড়ছে, কিন্তু আমার ভাইয়েরা মিথ্যে বলছে, তা কখনওই বিশ্বাস করতে পারি না।” এ-ও তিরস্কার, কিন্তু হিংসার আঘাত নয়। বিরুদ্ধমতের সামনেও নিজের কথা দৃঢ় কিন্তু শান্ত, সংযত ভাবে বলতে পারার শিক্ষাই ভাষার শিক্ষা। গণতন্ত্রের শিক্ষাও বটে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy