শিক্ষাই যে সামাজিক চলমানতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়ুধ, সে কথাটি এমনকি অনতিশিক্ষিত অভিভাবকরাও বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু, সন্তানের জন্য সে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে অভিভাবকদের কতখানি ‘মূল্য’ চোকাতে হয়, ধরা পড়ল সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায়। কম্প্রিহেনসিভ মডিউলার সার্ভে: এডুকেশন ২০২৫ (এপ্রিল-জুন) দ্বারা সংগৃহীত তথ্য অনুসারে, দেশ জুড়ে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের তুলনায় ন’গুণ বেশি ফি গুনতে হয়। এই মুহূর্তে এটি শিক্ষাক্ষেত্রের একটি চেনা ছবি। বিশেষত, বিষয়টির সঙ্গে বিলক্ষণ পরিচিত এই রাজ্যের অভিভাবকরা। অথচ, সরকারি স্কুলের পড়ার খরচ তুলনায় অনেক কম হলেও এবং সেখানে ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা মিললেও বেসরকারি স্কুলের জনপ্রিয়তা এমন ঊর্ধ্বমুখী কেন? কারণ, প্রচলিত ধারণা— সরকারি স্কুলে লেখাপড়া হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিকাঠামোগত খামতি ছাড়াও অব্যবস্থা, দুর্নীতি, শিক্ষকদের কাজের পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের অভাব এবং সর্বোপরি সরকারি উদাসীনতা এই স্কুলগুলিকে দুর্বল করেছে। এমতাবস্থায়, ভাল শিক্ষা, নিয়মানুবর্তিতা, ইংরেজি শিক্ষার আশায় বেসরকারি স্কুলের দিকে অভিভাবকরা ঝুঁকছেন, আর্থিক সমস্যা স্বীকার করেও।
তবে বেসরকারি স্কুলে পাঠিয়েই অভিভাবকদের খরচ শেষ হয় না। স্কুল ফি-র পাশাপাশি তাঁদের মোটা অর্থ ব্যয় করতে হয় প্রাইভেট টিউশনেও। দুর্ভাগ্য, বহু কাল যাবৎ এ রাজ্য একটি ঐতিহ্য প্রচলিত— স্কুল শুধু নাম লেখানোর জন্য, পড়াশোনা হয় মূলত প্রাইভেট টিউটরের কাছেই। বস্তুত, স্কুলশিক্ষায় ইউনিট টেস্ট ও প্রোজেক্ট ওয়ার্ক এখন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এর মূল্যায়নের সঙ্গে স্কুলশিক্ষকদের সরাসরি যোগ থাকায় অধিকাংশ অভিভাবকই মনে করেন, তাঁদের কাছে ছেলেমেয়েদের আলাদা করে পড়তে পাঠালে সুবিধা হবে, নম্বর পাওয়া যাবে বেশি। আবার, বহু স্কুলশিক্ষক এই সুযোগের ষোলো আনা ‘সদ্ব্যবহার’ করেন। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। এ ক্ষেত্রে প্রাইভেট টিউশনের বাজারটি অসম। ফলে কারও কাছেই নিখুঁত তথ্য থাকে না যে কোন শিক্ষক সত্যিই ভাল পড়ান, কে নন। বরং, পুরোটাই নির্ধারিত হয় কার কাছে কত ছাত্রছাত্রী পড়তে যাচ্ছে এবং তিনি কত বেতন নিচ্ছেন, তার উপরে। এমতাবস্থায় এই তথাকথিত ‘ভাল’ শিক্ষকদের কাছে সেই অভিভাবকরাই তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠাতে পারেন, যাঁদের সেই খরচ বহন করার ক্ষমতা রয়েছে। এর ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকট হচ্ছে বৈষম্য, যা সামাজিক অসাম্যকে আরও ভয়ানক করে তুলছে।
স্কুলের বাইরে যদি সব শিক্ষার্থীকে আলাদা করে সময় ও অর্থ দিয়ে পড়তে হয়, তার মানে সরকারি, বেসরকারি নির্বিশেষে কোনও স্কুলেই লেখাপড়া হয় না, শিক্ষকেরা ঠিকমতো পড়ান না। কেন এই পরিস্থিতি? শিক্ষাব্যবস্থায় পরিকাঠামো এবং সার্বিক ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত, যেখানে শিক্ষার্থীরা স্রোতের মতো প্রাইভেট টিউশনের জন্য দৌড়বে না, সমস্ত চাহিদা মিটবে শিক্ষাকেন্দ্রেই। বর্তমানে তা হচ্ছে কই? তাই, স্কুলশিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন আসলে শিক্ষাক্ষেত্রে মুশকিল আসান, না কি ঝোপ বুঝে কোপ— এই প্রশ্ন আলোচিত হওয়া দরকার। না হলে, পড়ুয়াদের শিক্ষার ‘অধিকার’ এই শিক্ষকদের হাতে ক্রমে এক প্রহসনে পরিণত হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)