E-Paper

মাত্রাছাড়া

ইউটিউবার-পডকাস্টার রণবীর ইলাহাবাদিয়া এক কমেডি শোয়ে সম্প্রতি মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে তাঁর শিক্ষা হল।

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৫:৫২

কমেডি, রসিকতা, ঠাট্টা— এই সবই আছে প্রতিটি সংস্কৃতিতেই। সংস্কৃতিবিশেষেই নিহিত তার সীমাও: কোন রঙ্গটি কোন বিন্দু পর্যন্ত নিয়ে এসে ছেড়ে দিতে হয়, তার পরেও তাকে টেনে নিয়ে চললে তা আর বিন্দুমাত্র ঠাট্টা থাকে না, সেই লক্ষ্মণরেখা। কোনও গোষ্ঠী-সংস্কৃতি বেশি রসসহিষ্ণু, কেউ আবার সহজেই স্পর্শকাতর। কিন্তু সংস্কৃতিনির্বিশেষে গোড়ার সত্যটি হল, কোনও রসিকতা যেন কোনও অবস্থাতেই বাক্‌স্বাধীনতার অপব্যবহার হয়ে না ওঠে, সেই মাত্রাজ্ঞান নিয়ন্ত্রণে রাখা। ইউটিউবার-পডকাস্টার রণবীর ইলাহাবাদিয়া এক কমেডি শোয়ে সম্প্রতি এই মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে তাঁর শিক্ষা হল। শীর্ষ আদালত তাঁকে চরম ভর্ৎসনা করে বলেছে, তাঁর মনের ভিতরের জঞ্জালই যেন এই ভিডিয়োর মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, ওই শব্দচয়ন এত অশালীন যে শুনে গোটা সমাজ লজ্জিত হবে।

রণবীরের মন্তব্যের জেরে তাঁর বিরুদ্ধে নানা রাজ্যে একাধিক এফআইআর হয়েছে, প্রাণনাশের হুমকিও এসেছে। পরে আদালতের হস্তক্ষেপেই শর্তসাপেক্ষে পাওয়া গেছে আইনি রক্ষাকবচ: রণবীর পুলিশের কাছে সুরক্ষা চাইতে পারবেন, তদন্তে সাহায্য করলে তাঁকে গ্রেফতার করা যাবে না, তাঁর নামে নতুন মামলাও করা যাবে না। এই সবই এক ‘বিপন্ন’ নাগরিকের সুরক্ষায় বিচারব্যবস্থার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, সংবিধানেই যে সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা আছে। ভারতের শীর্ষ আদালতের রক্ষক ও অভিভাবকসুলভ দ্বিবিধ ভূমিকা এই ঘটনায় প্রমাণিত আবারও— মহামান্য বিচারপতিরা এক দিকে যেমন তাঁর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন, অন্য দিকে তেমনই তীব্র তিরস্কারে বুঝিয়ে দিয়েছেন, রণবীর যা করেছেন তা দায়িত্বজ্ঞানহীন, বাক্‌স্বাধীনতা মানেই এক জন নাগরিক সমাজরীতি অতিক্রম করে যা খুশি তা-ই বলতে পারেন না: এমনকি তিনি বিখ্যাত বা জনপ্রিয় হলেও নয়।

এই কথাটিই মূলের সত্য, এমনকি শিল্প ও শিল্পীর স্বাধীনতার প্রেক্ষিতেও। শিল্পের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এই কথাটি বারংবার শোনা যায় যে, শিল্পের আসল কাজই হল গতানুগতিকতাকে আঘাত করা, স্থাণু সামাজিকতাকে বিদ্ধ করা। যুগে যুগে বিশ্বের যুগান্তকারী শিল্পীরা সে কাজই করেছেন। তবে এ কথাটি মনে রাখতে হবে যে, বিধিবদ্ধ সৌজন্যের ধার ধারেনি তাঁদের শিল্প— তাঁদের ব্যক্তিগত আচরণ বা জীবনচর্যার অসৌজন্য নয়। কমেডি শোয়ে রণবীর ইলাহাবাদিয়ার যে মন্তব্যের জেরে এত কিছু তা প্রথাবিরুদ্ধ শিল্পের ধারেকাছেও যায় না, তা আগাগোড়া অশোভন চটুলতা, সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়ানোর পন্থা। এই প্রসঙ্গেই শীর্ষ আদালতের আর একটি নির্দেশের কথাও বলতে হয়— রণবীর-কাণ্ডে মহামান্য বিচারপতিরা জানতে চেয়েছেন, ভবিষ্যতে সমাজমাধ্যমে এ-হেন ‘অশালীনতা’ আটকাতে সরকার কী ভাবছে; এবং যদি সরকার কিছু না করে, সেই নিষ্ক্রিয়তার শূন্যস্থান রাখা হবে না বলেও জানিয়েছেন তাঁরা। সমাজমাধ্যম মাত্রেই আন্তর্জাল-নির্ভর, মানুষের বিনোদনের সিংহভাগ আজ দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যম বেয়ে আসছে। প্রযুক্তিবাহিত ‘কনটেন্ট’-এ ক্রমশ গুলিয়ে যাচ্ছে শিষ্ট-অশিষ্ট, সৌজন্য-অসৌজন্যের ভেদরেখা, ভয়টা সেখানেই। সভ্যতার খাতিরেই প্রযুক্তিতে বাঁধ দেওয়া চলে না, ‘সভ্যতা’ অক্ষুণ্ণ রাখতেই দরকার নাগরিকের স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানও। আদালত আর কত শেখাবে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Youtuber Supreme Court of India Podcast

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy