চলতি বছর থেকেই জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে সিমেস্টার পদ্ধতি চালু করার কথা আগেই ঘোষণা করেছিল উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ। এ বার তারা জানাল, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কী ভাবে এই পদ্ধতিতে পড়াতে হবে, তার জন্য জুন মাসের প্রথম দিক থেকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে শিক্ষক প্রশিক্ষণ চালু হবে। নিয়ম অনুযায়ী, অনলাইন প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে এক সঙ্গে শতাধিক শিক্ষকের যোগ দেওয়া সম্ভবপর নয়। কিন্তু এই বিশেষ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দ্রুত সম্পন্ন করতে বিশেষ অনুমতি নিয়ে যোগদানকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে শিক্ষা সংসদের দাবি, এক হাজার শিক্ষক একত্রে এই প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন।
সমস্যা হল, এই প্রক্রিয়া নিয়ে ধন্দে শিক্ষকরাই। কারণ, দীর্ঘ গরমের ছুটির পরে আজ থেকে স্কুলে যোগ দেবে ছাত্রছাত্রীরা। এমতাবস্থায় নতুন সিমেস্টার চালু করার পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ আরও আগে থেকে করার প্রয়োজন ছিল। এমনিতেই সিমেস্টার পদ্ধতিতে সমস্যা রয়েছে বিবিধ। এই পরীক্ষাব্যবস্থায় পঠনপাঠনের সময় কিছুটা হলেও হ্রাস পায়। এই সঙ্কুচিত সময়ে নতুন পাঠ্যক্রম শেষ করে পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুত করার গুরুদায়িত্বটি বর্তায় শিক্ষকদের উপরেই। অথচ, বর্তমানে বহু সরকারি এবং সরকারপোষিত স্কুল নিয়মিত শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। রাজ্যের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বহু স্কুলে পর্যাপ্ত সংখ্যক নিয়মিত শিক্ষক না থাকায় ক্লাস নিয়ে থাকেন আংশিক সময়ের শিক্ষকেরা। সিমেস্টার পদ্ধতি চালু করতে এই অস্থায়ী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে কি না, সেই নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। তেমনটা না হলে বহু প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার ক্ষেত্রে যে সমস্যার সৃষ্টি হবে, সে আশঙ্কা ভরপুর। তা ছাড়া, রাজ্যের বহু স্থানে ইন্টারনেট যোগাযোগের অবস্থা আদৌ ভাল নয়। সে ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে অনলাইন প্রশিক্ষণ কী ভাবে দেওয়া যাবে, সেই বিষয়ে ভাবা হয়েছে কি? অন্য দিকে, নতুন সিমেস্টার পদ্ধতিতে বদলেছে পাঠ্যক্রমও। পাঠ্যপুস্তকেও হয়েছে প্রচুর পরিবর্তন। অথচ অভিযোগ, বাংলা, ইংরেজি থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, কলা এবং বাণিজ্য শাখার বহু বই এখনও বাজারে অমিল। এমতাবস্থায় একাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা যেমন আগে থেকে পড়াশোনা শুরু করতে পারেনি, তেমনই স্কুলে তাদের কী পড়ানো হবে, সেই নিয়ে নিশ্চিত নন শিক্ষকরাও। প্রশিক্ষণ শুরুর পূর্বে এই সমস্যাগুলির সমাধান অবশ্যই প্রয়োজন ছিল।
নিঃসন্দেহে, কোনও দেশ বা রাজ্যের অগ্রগতির পরিমাপটি বোঝা যায়, সামগ্রিক ভাবে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখে। পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, অতীত-বর্তমান মিলিয়ে এ-যাবৎ কালে এই রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রের যে ছবিটি উন্মোচিত হয়েছে তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, শিক্ষা বিষয়ে সামগ্রিক চিন্তাভাবনা এবং দূরদর্শিতার অভাব এই রাজ্যে প্রকট। শুধুমাত্র পরীক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন সাধন করে অথবা তার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেই প্রশাসনের শিক্ষা বিষয়ক দায়িত্বটি শেষ হয়ে যায় না। নতুন পরিস্থিতিতে উদ্ভূত সমস্যাগুলির মোকাবিলা করা হবে কী ভাবে, তার জন্য প্রশাসনিক স্তরে সুষ্ঠু পরিকল্পনারও প্রয়োজন। প্রচলিত ব্যবস্থাটি পরিবর্তনগুলিকে কতটা দক্ষতার সঙ্গে আয়ত্ত করতে পারবে, তার পর্যালোচনাও প্রয়োজন। না হলে সরকারপোষিত শিক্ষাব্যবস্থার আপাত উন্নতির আড়ালে আরও অবমূল্যায়ন ঘটবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)