অবশেষে স্বস্তি সংবাদ: জনগণনা শুরুর সময় ঘোষণা করেছে ভারত সরকার। বর্তমানে ২০১১ সালের তথ্যের ভিত্তিতে ১৪০ কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে। ফলে সরকারি নীতির বাস্তবমুখিতা, জনকল্যাণের নানা প্রকল্পের ন্যায্যতা, অর্থনীতির সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা, সবই সংশয়ের মুখে পড়েছে। ২০২১ সালে হওয়ার কথা ছিল যে জনগণনার, কেনই বা তা শুরু হবে ২০২৭ সালে, সে প্রশ্নও উঠেছে। দশ বছর অন্তর জনগণনা ভারতবাসীর জীবন-স্পন্দনের ছন্দ হয়ে উঠেছিল। ১৮৮১ সালে যার সূচনা, তার ধারাবাহিকতায় প্রথম ছেদ পড়ল ২০২১ সালে। কোভিড অতিমারি তার বাস্তবিক কারণ, না কি অছিলামাত্র? ব্রিটেন, আমেরিকা, চিন-সহ বেশ কয়েকটি দেশ যদি কোভিডে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও যথাসময়ে জনগণনা সেরে ফেলতে পারে, ভারত কেন পারল না? বিলম্ব যত দীর্ঘ হয়েছে, ততই সন্দেহ গাঢ় হয়েছে যে, দেরির আসল কারণ প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক। শোনা যায়, কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকপঞ্জি তৈরি শেষ করে জনগণনা শুরু করতে চেয়েছিল, কিন্তু প্রতিরোধের তীব্রতায় পিছু হটেছে বলে জনগণনা পিছিয়েছে। আবার, বিরোধীদের দাবি মেনে জনগণনার সঙ্গে জাতিগণনায় সম্মতি দিতে কেন্দ্রের অনিচ্ছাও বিলম্বের কারণ। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ওবিসি-র সংখ্যা প্রকাশ করার ঝুঁকি সম্ভবত এড়াতে চেয়েছে মোদী সরকার। প্রকৃত সংখ্যা সামনে এলে সংরক্ষণের বর্তমান নকশা ঢেলে সাজাতে হতে পারে।
জাতিগণনার দাবি শেষ অবধি মেনে নিয়েছে কেন্দ্র, সম্ভবত এ বছর বিহার নির্বাচনে কিঞ্চিৎ লাভের আশায়। কিন্তু ১ মার্চ ২০২৭ তারিখটিকে জনগণনার ‘রেফারেন্স ডেট’ ঘোষণা করায় বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির অভিযোগ ফের প্রবল হয়েছে, এ বার আসন পুনর্বিন্যাসকে কেন্দ্র করে। দক্ষিণ ভারতের নানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের দাবি, তাঁদের রাজ্যগুলির সাংসদ কমিয়ে, উত্তর ভারতের জনবহুল রাজ্যগুলির আসন বাড়াতে চায় মোদী সরকার। জনসংখ্যায় পরিবর্তন অনুসারে লোকসভা এবং বিধানসভার নির্বাচনী ক্ষেত্রের পুনর্বিন্যাসের নির্দেশ রয়েছে সংবিধানে। সেই মতো ১৯৫১ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে তিন বার আসন পুনর্বিন্যাস হয়ে লোকসভার আসন সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৭৬ সালে ইন্দিরা গান্ধী সরকার সংবিধান সংশোধন করে পুনর্বিন্যাস স্থগিত করে তিরিশ বছরের জন্য, যাতে জনবহুল রাজ্যগুলি নির্বাচনী রাজনীতিতে বাড়তি সুবিধে না পায়। ২০০২ সালে আরও কুড়ি বছরের জন্য পুনর্বিন্যাস স্থগিত রাখা হয়। সংশোধন অনুযায়ী ২০২৬-পরবর্তী জনগণনার ভিত্তিতে ফের আসন পুনর্বিন্যাস করা যাবে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী, ডিএমকে নেতা স্ট্যালিন তাই দাবি করেছেন, জন্মহার নিয়ন্ত্রণে সফল দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে ‘শাস্তি’ দিতে কেন্দ্র জনগণনাকে ঠেলে দিয়েছে ২০২৭ সালে, যাতে আসন পুনর্বিন্যাস করে সংসদে কোনও অঞ্চলের সাংসদ কমানো, কোনও অঞ্চলে বাড়ানো যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আশ্বাস, দক্ষিণের রাজ্যগুলির স্বার্থ বিবেচনা করা হবে। স্ট্যালিনের দাবি, প্রতিশ্রুতি নয়, চাই একটি সংসদীয় কমিটি, এবং সংবিধান সংশোধন।
অতএব জনগণনার ঘোষণায় যেমন আশা জেগেছে, তেমন জেগেছে আশঙ্কাও। ন্যায় ও উন্নয়নের ভিত্তি যে জনগণনা, দলীয় রাজনীতির লাভের আশায় তাকে যথেচ্ছ স্থগিত করছে সরকার, আসন পুনর্বিন্যাসের মতো সাংবিধানিক নির্দেশকে নির্বাচনী স্বার্থে প্রয়োগ করছে, এমন সন্দেহ জাগলেও তা গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। এখন সরকারের কাছে দাবি, তৎপর, স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ভাবে জনগণনার বিপুল কাজ সমাধা করা, এবং তার ফলাফল যথাসময়ে প্রকাশ করা। জনগণনা, জাতিগণনার সম্পূর্ণ ফল জানার অধিকার রয়েছে প্রতিটি নাগরিকের। যদিও ২০২৯ সালের আগে ফল প্রকাশ হবে না। যার একটা অর্থ, ২০৩৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে সংসদের এক-তৃতীয়াংশ আসনে মহিলাদের দেখা যাবে না।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)