বয়কট কি অন্যায়কে রুখতে পারে, নাকি বয়কটের জন্য ঘটে যায় নানা রকম অন্যায়? এই বিতর্কের কেন্দ্রে এ বার হলিউড। প্যালেস্টাইনের উপর ইজ়রায়েলের ধারাবাহিক আক্রমণ, জাতিবিদ্বেষ এবং গণহত্যার প্রতিবাদ করতে আমেরিকার অভিনেতা ও কলাকুশলীদের একাংশ ঘোষণা করেছেন যে, যে সব ইজ়রায়েলি সংস্থার সংযোগ বা সমর্থন রয়েছে এই ভয়ঙ্কর আগ্রাসনের প্রতি, সেগুলির সঙ্গে তাঁরা কাজ করবেন না। অলিভিয়া কোলম্যান, এমা স্টোন, জাভিয়র বার্ডেম, টিলডা সুইনটন, মার্ক রাফালো-সহ অনেক তারকা এই প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে আমেরিকা থেকে এই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। প্রায় চার হাজার মানুষ স্বাক্ষর করেছেন। নৈতিক কারণে কোনও দেশকে বয়কটের এমন সঙ্ঘবদ্ধ চেষ্টা এর আগে দেখা গিয়েছিল ১৯৮৭ সালে, যখন সাউথ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী নীতির প্রতিবাদ করেছিল হলিউড। সে দেশে শুটিং না করা, সেখানে ছবি প্রদর্শন না করা, সে দেশের কোনও অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ‘ফিল্মমেকার্স ইউনাইটেড এগেনস্ট অ্যাপার্থেড’ সংগঠন। যার সদস্য ছিলেন উডি অ্যালেন, মার্টিন স্কর্সেসির মতো নামী পরিচালকরা। হলিউডের ভিতরেও নানা বৈষম্য, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বয়কটকে ব্যবহার করেছেন তারকারা। অ-শ্বেতাঙ্গ অভিনেতা ও কলাকুশলীদের উপেক্ষার জন্য অ্যাকাডেমি (অস্কার) পুরস্কারের সম্মাননা অনুষ্ঠান ২০১৬ সালে বয়কট করেছিলেন বেশ কিছু কৃষ্ণাঙ্গ তারকা। সাম্প্রতিক ঘোষণায় অভিনেতা-কলাকুশলীরা বলেছেন, নানা দেশের সরকার গাজ়ার গণহত্যাকে হতে দেখেও বাধা দিচ্ছে না। এই ভয়ানক কাণ্ডকে বন্ধ করার জন্য তাঁদের পক্ষে যা করা সম্ভব, তা তাঁরা করবেন। ইজ়রায়েলের নানা প্রযোজনা সংস্থা তাদের ছবিতে প্যালেস্টাইনিদের ‘অমানুষ’ হিসেবে চিত্রিত করে, ইজ়রায়েলের আগ্রাসনকে যুক্তিযুক্ত করে দেখাতে চায়। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আগেই সরব হয়েছিলেন প্যালেস্টাইনের চলচ্চিত্র-নির্মাতারা। এ বার তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে আন্তর্জাতিক নানা তারকা জানিয়েছেন, জেরুসালেম বা হাইফার চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতে যোগ দেবেন না তাঁরা। কেননা, সেগুলি ইজ়রায়েলের সরকারের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয়।
প্রবলের অন্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে দুর্বলের হাতে প্রতিবাদের আর কী-ই বা অস্ত্র রয়েছে, অসহযোগিতা ছাড়া? বয়কটকে তাই নৈতিকতার নির্দেশ বলে মনে করেন অনেকেই। তা ছাড়া বয়কট বেশ সোজাসাপটা পথ, তাই সহজেই অনেকের সম্মতি পাওয়া যায়। বাস্তবে বয়কটের প্রভাব কিন্তু বিচিত্র, বহুস্তরীয় হতে পারে। ইজ়রায়েলি চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলছেন, এই বয়কটের ফলে হিতে বিপরীত হবে। কারণ বহু ইজ়রায়েলি চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, সরকারের সমালোচনা করে ছবি তৈরি করছেন। ইজ়রায়েলের সমাজ ও রাজনীতির জটিলতাকে ধরতে চাইছেন তাঁদের ছবিতে। এই বয়কটের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেই সব প্রচেষ্টাই। এতে শান্তির পথ প্রশস্ত হবে না। বরং যাঁরা সংলাপ চালু রাখতে, দু’পক্ষের মধ্যে সেতু বন্ধন করতে দায়বদ্ধ, তাঁদের আঘাত করবে। বিধ্বস্ত গাজ়ার ছবির সামনে ইজ়রায়েলি লেখক-পরিচালকদের কথা এই মুহূর্তে হয়তো ফাঁপা শোনায়। কিন্তু যে কোনও বয়কটের ডাকের মধ্যে কোনও এক ‘প্রতিপক্ষ’ নির্ধারণ করে, তাকে সম্পূর্ণ বর্জন করার ইচ্ছা, সংলাপ ছিন্ন করার চেষ্টা থাকে। প্রতিবাদের আবেগই তখন যেন বড় হয়ে ওঠে, পরিণামের চিন্তার চাইতে। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর অসহযোগিতা ও বয়কট আন্দোলনকে কিছুতেই সমর্থন করতে রাজি হননি, তার নেতিবাচক দিকটি দেখতে পেয়েছিলেন। অসহযোগিতাকে তাঁর মনে হয়েছিল হিংসার নিশ্চেষ্ট রূপ।
আজ যদিও বর্জনের ডাক প্রধানত প্রতীকী, তবু তাকে কাজে লাগানোর বিপদগুলো গত কয়েক দশকে ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে। যেমন, নাগরিকের এই অস্ত্রকে সহজেই কব্জা করে শাসক, কণ্ঠরোধ করতে। চার্লি চ্যাপলিন আমেরিকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘কমিউনিস্ট’ সন্দেহে একঘরে হয়েছিলেন বহু অভিনেতা-পরিচালক। বয়কটের কার্যসূচি কখনও রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের থেকে ব্যক্তিকে আলাদা করতে পারে না। আর সেখানেই ঘটে মনুষ্যত্বের বিপর্যয়। যখন ভারতে অসহযোগিতা আন্দোলন চলছে, সে সময়ে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসাই হল চরম সত্য। অসহযোগিতা তাকে আঘাত করে। ইজ়রায়েলের চিত্রনির্মাতাদের কথা থেকেও সেই ইঙ্গিত মেলে— যার উদ্দেশ্য পীড়নের প্রতিবাদ, তা-ই বাড়াতে পারে পীড়িতের বিপন্নতা। বয়কটের এই সঙ্কট চিরকালীন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)