কমলবনে মত্ত হস্তী’ বললে ইদানীং বহুবিধ ছবি মাথায় ভিড় করে আসতে চায়। তবুও, সেই অসংখ্য বিকল্পের মধ্যে থেকে ২০২৫-এর প্রথম কয়েক মাসের সেরা ছবিটি বেছে নিতে হলে সম্ভবত জিতবেন ইলন মাস্ক। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনে বিপুল আর্থিক ভূমিকা পালনের পর তাঁর জন্য তৈরি হয়েছিল একটি নতুন দফতর— ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি (সংক্ষেপে, ডজ)। মাস্ক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যয় কমাবেন অন্তত দু’লক্ষ কোটি ডলার। সরকারের কর্মকুশলতা বৃদ্ধির নির্বিকল্প পথ হিসাবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন গণ ছাঁটাইকে। ডজ-এর শীর্ষপদে তাঁর ১২৯ দিনের মেয়াদে আমেরিকা জুড়ে ত্রাসের স্রোত বয়ে গিয়েছে। কুড়ি লক্ষ কর্মী মেল পেয়েছেন, যাতে জানতে চাওয়া হয়েছে: “গত এক সপ্তাহে আপনি কী করেছেন?” ইউএসএড থেকে স্বাস্থ্য দফতর, সর্বত্র বিপুল ভাবে ছাঁটা হয়েছে ব্যয়বরাদ্দ। বরখাস্ত হওয়ার চিঠি পেয়েছেন অসংখ্য ফেডারাল কর্মী। মামলার পাহাড় জমেছে ডজ-এর বিরুদ্ধে। আদালত ডজ-এর বেশ কিছু সিদ্ধান্তকে নাকচ করেছে; মাস্ক পাল্টা আক্রমণ করেছেন বিচারবিভাগকে। অন্য দিকে, তাঁর বিরুদ্ধে জমতে থাকা ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে তাঁর সংস্থা টেসলা-র বিরুদ্ধে। দুনিয়ার বিভিন্ন শহরে টেসলার শোরুমের বাইরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন সাধারণ মানুষ; আক্রমণও করেছেন কোথাও কোথাও। গাড়ির বিক্রি কমেছে, পড়েছে সংস্থার শেয়ারের দামও। শেষ অবধি ৩০ মে মাস্ক জানালেন, তিনি পদত্যাগ করছেন। দেখা গেল, যত ব্যয় কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি, তার প্রায় কিছুই হয়নি। এমনকি, ডজ-এর ওয়েবসাইটে যে সব হিসাব দেওয়া আছে, তারও অর্ধেকের কোনও প্রামাণ্য ভিত্তি মিলছে না।
‘দুনিয়া কাঁপানো ১২৯ দিন’-এই কি ট্রাম্প-মাস্ক পর্বের সমাপ্তি ঘটল? আদালতে জমে থাকা মামলার পাহাড় অন্য কথা বলবে। কিন্তু, সেই প্রত্যক্ষ প্রভাবের কথা বাদ দিলেও এই পর্বটি দুনিয়ার যে কোনও প্রান্তের সর্বাধিপত্যকামী উগ্র দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রনায়কদের কাছে একটি শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা হতে পারে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কার্যত প্রত্যেক দক্ষিণপন্থী সর্বাধিপত্যকামী নেতার পিছনেই উপস্থিতি রয়েছে কোনও না কোনও ‘অলিগার্ক’-এর— এমন ধনকুবের ব্যবসায়ী, নিজের স্বার্থে যিনি রাষ্ট্রীয় বা বৈশ্বিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান, কিন্তু প্রত্যক্ষ ভাবে নয়, সেই সর্বাধিপত্যকামী নেতার মাধ্যমে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে ইলন মাস্ক ছিলেন সেই অলিগার্ক। বস্তুত, ট্রাম্প যে মাস্কের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করছেন এবং করবেন, এই কথাটি দু’জনের এক জনও বিশেষ গোপন করতে চাননি। কিন্তু, অলিগার্কির স্বীকৃত মডেল-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত লঙ্ঘন করেছিলেন তাঁরা— নেপথ্যে থাকার বদলে ইলন মাস্ক চলে এসেছিলেন প্রকাশ্যে। তার প্রত্যক্ষ ফল: অলিগার্ক-এর যে দাবিগুলি রাজনীতির কষ্টিপাথরে ঘষে তার পর বাস্তবায়িত হয়ে থাকে, এ ক্ষেত্রে সেগুলি একেবারে নগ্ন ভাবে প্রকাশ্যে এল। মাস্ক যে ভঙ্গিতে প্রশাসন চালাতে চাইছিলেন, সেটি অচেনা নয়— যেমন, টুইটার কেনার পর মাস্ক সেখানে এই ভঙ্গিতেই নিজের দখল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু, কোনও অতিবৃহৎ কর্পোরেটের সঙ্গেও একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পার্থক্য অনপনেয়— গণতন্ত্রেই সেই পার্থক্য নিহিত। ট্রাম্প-মাস্ক সেই দূরত্বকে অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন। তার ফল গোটা দুনিয়ার সামনে। ভবিষ্যতের একনায়করা এই অভিজ্ঞতা থেকে শিখবেন নিশ্চয়ই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)