E-Paper

মৌষল পর্ব

চাঁদার অঙ্কে অসুবিধা থাকলে ‘একটা শূন্য যোগ করে দিই?’ বলার হিমেল হুমকিই যেখানে সুবিদিত, সেখানে আপত্তি বা অপারগতা জানালে যে কত দিক থেকে বিপদ আসবে, তার কি হিসাব আছে?

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:১৯

দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার ও আক্রমণ— এখন সমাজ ও রাজনীতির নিয়মিত ও অবারিত ঘটনা। আলোর সপ্তাহের প্রথম দু’দিনেই রাজ্যের দু’জায়গায়সেই নৈরাজ্যের অন্ধকারের সংবাদ। উল্টোডাঙার মুরারিপুকুরের সাতান্ন বছরের এক প্রৌঢ়, যিনি নিজে প্রতিমার সাজশিল্পী, রাত এগারোটার সময় কাজ শেষে ঘরের ফেরার পথে প্রচণ্ড মার খেলেন। তাঁদের পারিবারিক বন্ধ সেলুনটির জন্যই কালীপুজোয় ২০০১ টাকা চাঁদা দাবি করার অভিযোগ স্থানীয় ক্লাবের বিরুদ্ধে। অনাদায়ে, শ্রান্ত বয়স্ক শিল্পীকে ক্লাবের সামনে থেকে মারতে মারতে বাড়ি নিয়ে গেল মদমত্তরা। প্রৌঢ়ের সারা শরীরে এখন মারের দাগ, কপালে পাঁচটা সেলাইয়ের ক্ষত। অন্য ঘটনাটি পরের বিকেলের। এ বারে, আবারও হামলা চিকিৎসকের উপর। উলুবেড়িয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসকের দাবি, এক অন্তঃসত্ত্বার অসহযোগিতার কারণে তিনি তাঁকে সিনিয়র চিকিৎসকের অপেক্ষা করতে বলেন। পরিবারের লোকজন রণমূর্তি ধরেন। চড়থাপ্পড় চলে, সঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ। পরিবারের লোকের মধ্যে ছিলেন অন্তঃসত্ত্বার কাকা, যিনি পেশায় উলুবেড়িয়া ট্রাফিক গার্ডের অস্থায়ী হোমগার্ড। তাঁর বক্তব্য, উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে মাত্র।

উপর্যুপরি এমন খবরে ত্রাস, ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়, বিস্ময় নয়। কারণ, এমন ঘটনা অহরহ দেখা ও পরিণতিও জানা। নিগৃহীতদের শরীর ও মনের দাগ মেলাবার আগেই ফাইলে ধুলো চাপে, অভিযুক্তরা খালাস পায়। এই অব্যাহতি পাওয়ার চক্র দস্তুর হয়ে গিয়েছে বলেই সভ্যতার সীমা লঙ্ঘন করে এক নাগরিক অন্য নাগরিককে শারীরিক নিগ্রহের মতো আদিম যুগীয় বর্বরতা দেখাতে পারছেন। অনুসন্ধান করলেই দেখা যাবে, গণতান্ত্রিক আইনবদ্ধ সমাজের পরিপন্থী এই নির্যাতনের পিছনে দায়ী রাজনৈতিক মদত। প্রথম ঘটনার কুশীলব মত্ত পুজো-উদ্যোক্তারা, যারা শাসকের কাছের না হলে কি আর হাতে-পায়ে এত জোর? চাঁদার অঙ্কে অসুবিধা থাকলে ‘একটা শূন্য যোগ করে দিই?’ বলার হিমেল হুমকিই যেখানে সুবিদিত, সেখানে আপত্তি বা অপারগতা জানালে যে কত দিক থেকে বিপদ আসবে, তার কি হিসাব আছে?

দ্বিতীয় ঘটনার ক্ষেত্রেও, পুলিশ-বাহিনী সংশ্লিষ্ট এমন একটি পদের নাম জড়িত, অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের দরুণ যাদের কর্তব্যবোধ ও ক্ষমতা জাহিরের সীমারেখা নিয়ে বহু প্রশ্ন রয়েছে। তবে, এ ক্ষেত্রে, অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য চিকিৎসালয়ের নিজস্ব বিভাগ থাকার কথা, যারা রোগী-চিকিৎসক উভয় পক্ষকেই নিরাপত্তার অভাব অনুভূত হতে দেবে না। কারণ, আঘাত করা, অপমানজনক বাক্যপ্রয়োগ, হুমকি দেওয়া অত্যন্ত বড় মাপের বিষয়, ফৌজদারি অপরাধ। মাত্রানুযায়ী তার শাস্তিও রয়েছে। কিন্তু পাড়ার মধ্যে এত ন্যায়-নীতির খেয়াল আর কে কবে রেখেছে, হাসপাতাল প্রশাসনেরও বা এত ঝামেলায় কী কাজ! কারণ কেউ যদি ধরাও পড়ে তো সে চাপ, হুমকি বা অর্থ প্রয়োগে ছাড়া পেয়ে যায়। এই আইন-প্রমাণ-সাক্ষ্য ব্যবস্থা এতই দীর্ঘ, জটিল ও পিচ্ছিল যে তাকে রক্ষা করতে কারও উৎসাহও জাগে না। দণ্ড হয় না— দেখতে দেখতে দণ্ড যে আছে, দুর্বৃত্ত ও ভুক্তভোগী সকলেই তা বিস্মৃত। বিচারের বাণীর নীরব ক্রন্দনের সুযোগেই প্রহার-সংস্কৃতির এহেন প্রতাপ চলছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Extortion Society

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy