নেহাত বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণেই ভিন রাজ্যে হেনস্থা হতে হচ্ছে বাঙালিকে— বহু বিলম্বে হলেও কথাটি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোচর হয়েছে। সাম্প্রতিক কালেই একাধিক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে বাংলাভাষী মানুষকে ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে হেনস্থা করেছে স্থানীয় লোক, এমনকি পুলিশও। অন্য রাজ্যে কেন, খাস কলকাতাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে নাকি বাংলায় কথা বলার জন্য হেনস্থা হয়েছেন কতিপয় ছাত্রী। বাঙালি-বিদ্বেষের ঘটনা এ দেশে নতুন নয়— ১৯৬০-এর দশকে অসমের ‘বঙ্গাল খেদা আন্দোলন’-এর কথা মনে পড়বে। এবং, অতীত হোক বা আজ, সব বাঙালি বিদ্বেষই রাজনৈতিক। ফারাক হল, সেই রাজনীতির চরিত্র এবং মূল প্রতিপাদ্য পাল্টে গিয়েছে। অতীতে অসম হোক বা বিহার, বাঙালি বিদ্বেষের মূল কারণ ছিল, সেই অঞ্চলে বাঙালির দাপট, সমৃদ্ধি এবং আধিপত্য। ভূমিপুত্রদের মূল অভিযোগ ছিল, নিজেদের রাজ্যে তারা বাঙালির কাছে পরাজিত। খণ্ড জাতীয়তাবাদী আঞ্চলিক আবেগনির্ভর রাজনীতি সেই অভিযোগে উস্কানি দিয়েছিল, তাকে রাজনৈতিক মূলধন করতে চেয়েছিল। ভিন রাজ্যে বাঙালির সেই আধিপত্য এখন অতীত। বেঙ্গালুরু-গুরুগ্রাম-পুণে-হায়দরাবাদের মতো শহরগুলিতে এখনও হোয়াইট-কলার চাকরিতে যথেষ্ট সংখ্যক বাঙালি কাজ করেন বটে, কিন্তু অন্যান্য প্রদেশের কর্মীরাও সেখানে ভাল অনুপাতেই আছেন। তার চেয়েও বড় কথা হল, স্থানীয়দের বিদ্বেষের কারণ হয়ে ওঠার জন্য স্থানীয় অর্থনীতি, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাক্ষেত্র— সর্বত্র আধিপত্যের প্রয়োজন, বাঙালির যা আজ কোথাও নেই। অতএব, বর্তমান বিদ্বেষের কারণটি ভিন্ন।
সেই কারণটি দ্বিবিধ। এবং, ঘটনাক্রমে দু’টিই ভারতের উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। প্রথম কারণটি হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের রাজনীতি। গত কয়েক বছরে বিজেপি ক্রমেই দেশ জুড়ে হিন্দির আধিপত্য কায়েমে ব্যস্ত। সেই আধিপত্যের উল্টো দিকটি হল, অন্যান্য ভাষার অবমাননা। রাজনীতির ধর্মই হল, তা ক্রমে সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে প্রবেশ করে— বিশেষত, সেই রাজনীতি যদি বিদ্বেষের হয়, তবে তা ছড়িয়ে পড়ে দ্রুততর বেগে, অধিকতর ব্যাপ্তিতে। বিজেপির হিন্দি আগ্রাসনের রাজনীতিও সে ভাবেই ছড়িয়েছে। হিন্দিভাষী মানুষ বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছেন যে, হিন্দিই ভারতের রাষ্ট্রভাষা, এবং ভারতীয় নাগরিক হতে হলে হিন্দিতে কথা বলা আবশ্যিক। জাতীয়তাবাদ যে-হেতু এখন মূলত গায়ের জোর-নির্ভর, ফলে অন্য ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠীকে তারা গায়ের জোরে জাতীয়তাবাদের সবক শেখাতে চায়। এই আগ্রাসনের শিকার মূলত দরিদ্র পরিযায়ী জনগোষ্ঠীর মানুষ। পরভূমে তাঁরা এমনিতেই অবলম্বনহীন, ফলে তাঁদের নিগ্রহ করে নিজেদের জাতীয়তাবাদী কেশর ফোলানোর কাজটি সহজ।
দ্বিতীয় কারণ বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। পশ্চিমবঙ্গের পথ দিয়ে ভারতে বাংলাদেশি মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঘটছে, দীর্ঘ দিন ধরে এই প্রচার চালিয়ে যাওয়ার ফল মিলেছে— উত্তর বা পশ্চিম ভারতে বহু মানুষের চোখেই এখন আর বাঙালি ও বাংলাদেশির মধ্যে কোনও ফারাক নেই। বিশেষত, ধর্মনির্বিশেষেই আমিষভোজী বাঙালিকে বাংলাদেশি মুসলমান ধরে নিতে তাদের সমস্যা আরও কম। অপরায়ণের রাজনীতির এই বিপদ অনিবার্য। কাজেই, মুখ্যমন্ত্রী ভিন রাজ্যে বাঙালি নিগ্রহ নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন, তাকে সেখানেই ছেড়ে দিলে হবে না— প্রশ্নটির গভীরে যাওয়া প্রয়োজন, মূলের সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আরও একটি কথা বুঝে নিতে হবে— এই বিদ্বেষের পাল্টা পশ্চিমবঙ্গে অ-বঙ্গভাষী বিদ্বেষের রাজনীতি করলে তা-ও হবে এই একই দোষে দুষ্ট। ভারত নামক দেশটি যে চরিত্রগত ভাবেই বহুভাষী, এবং কোথাও কোনও ভাষার দাবি অন্য কোনও ভাষার চেয়ে কম বা বেশি নয়, সে কথাটি প্রতিষ্ঠা করাই রাজনীতির কর্তব্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)