অন্য বারের তুলনায় সম্প্রতি জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলন বিবিধ কারণে ছিল ব্যতিক্রম। এক, এই প্রথম আফ্রিকার কোনও রাষ্ট্রে বৈঠক অনুষ্ঠিত হল। দুই, সম্মেলনে আমেরিকার অনুপস্থিতি এবং ঐতিহ্য ভেঙে আলোচনার শেষ দিনের পরিবর্তে শীর্ষ সম্মেলনের শুরুতে বিশ্ব নেতাদের যৌথ ঘোষণাপত্র গৃহীত হল। ঘোষণাপত্রে বহুপাক্ষিকতা, সন্ত্রাসবাদ এবং বিশ্বব্যাপী সংঘাতের উপরে শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা-সহ জলবায়ু, ঋণমুক্তি এবং উন্নয়নের উপরে আলোকপাত করা হল। রাষ্ট্রনেতারা স্বীকার করে নিলেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ এবং জলবায়ুর ক্ষেত্রে আর্থিক সহযোগিতা ‘বিশ্বব্যাপী সকল উৎস থেকে বিলিয়ন থেকে ট্রিলিয়ন’-এ উন্নীত হওয়া জরুরি। সেই সঙ্গে তাঁরা একটি উন্মুক্ত, ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করার পাশাপাশি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, নিম্ন-আয়ের দেশগুলিকে তাদের ঋণ মোকাবিলায় সহায়তা করার জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। অন্য দিকে, নেতারা রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদের ভিত্তিতে ইউক্রেন, সুদান, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো (ডিআরসি) এবং ‘অধীকৃত প্যালেস্টাইন অঞ্চল’-এ ‘ন্যায়সঙ্গত, ব্যাপক এবং স্থায়ী শান্তি’ প্রতিষ্ঠারও আহ্বান জানান।
সম্মেলনে ভারত নিজেকে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। গত এপ্রিলে পহেলগাম জঙ্গি হামলার পর থেকে ভারত যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নতুন করে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার উপর জোর দিয়ে এসেছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জি২০ ঘোষণাপত্রে সন্ত্রাসবাদের দ্ব্যর্থহীন ভাবে নিন্দা করা হয়েছে। জি২০-তে ভারতের সভাপতিত্বকালে শুরু হওয়া দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কর্মী গোষ্ঠীর ফলাফলগুলিকে ঘোষণাপত্রে আরও জোরদার করা হয়েছে, যা স্বীকৃতি দিয়েছে কোয়ালিশন ফর ডিজ়াস্টার রেজ়িলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার (সিডিআরআই)-এ ভারত এবং ফ্রান্সের ভূমিকাকেও। ভুললে চলবে না, জি২০ প্রতিনিধিত্বকারী উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ‘সিন্থেটিক ড্রাগ’ পাচার করে দীর্ঘদিন ধরেই তাদের কার্যকলাপের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে আসছে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি। এ ছাড়াও, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা প্রতিক্রিয়া দলের গঠন, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সঞ্চালন উদ্যোগ এবং উন্মুক্ত উপগ্রহ তথ্য অংশীদারির মতো প্রস্তাবগুলি ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর মধ্যে সংহতিকে আরও শক্তিশালী করারই ইঙ্গিতবাহী। অন্য দিকে, সম্মেলনের ফাঁকে ভারত, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া একটি ত্রিপক্ষীয় প্রযুক্তিগত অংশীদারি গঠনের কথা ঘোষণাও করেছে।
এ দিকে, দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ তুলে সম্মেলন বয়কট করেছিল আমেরিকা। বৈঠকে জলবায়ু সংক্রান্ত পদক্ষেপ এবং শক্তির রূপান্তরের বিষয়গুলির আলোচনা আমেরিকার নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ার ফলেই এই অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। সে ক্ষেত্রে পরের বছর আমেরিকার মায়ামিতে এই বৈঠকের ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। ফলে, এই বছরের ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত পরিচিত আফ্রিকান দর্শন ‘উবুন্টু’ বা ‘আমি আছি কারণ আমরা আছি’-র ভাবনা আগামী দিনও প্রাসঙ্গিক থাকবে কি?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)