নাগরিকের মানবাধিকার কতটা বিপন্ন, তা রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়। কমিশন কার্যত অস্তিত্বহীন, ন্যূনতম তিন জন সদস্যের কমিশনে দু’জনই নেই, শূন্য রয়েছে সভাপতির পদটিও। গত বছর সভাপতির কার্যকালের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। আনিস খান হত্যা, রামপুরহাটে অগ্নিসংযোগে গণহত্যার মতো বেশ কিছু মর্মান্তিক ঘটনায় পুলিশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগের অভিযোগ উঠেছে। রাজ্য জুড়ে তার প্রতিবাদ চলছে, কিন্তু নীরব দর্শক হয়ে রয়ে গিয়েছে মানবাধিকার কমিশন। সভাপতির অভাবে তদন্ত দল পাঠানোর ক্ষমতা নেই, প্রশাসনিক রিপোর্ট তলব করার এক্তিয়ার নেই। দেশের আইন যে প্রতিষ্ঠানকে নাগরিকের সুরক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জঘন্যতম নিদর্শনের সম্মুখে সেই কমিশন যদি নীরব দর্শকের ভূমিকা নেয়, তা হলে কোন ভরসায় বাঁচবে রাজ্যবাসী? সংবাদে প্রকাশ, মুখ্যমন্ত্রী ও বিধানসভার স্পিকার মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি পদের জন্য যাঁকে মনোনীত করেছিলেন, বিধানসভার বিরোধী নেতা তাঁর নামে আপত্তি করেছেন। নিয়োগে রাজি হননি রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ও। ফলে অচলাবস্থা চলছে, কবে রাজ্যের মানবাধিকার কমিশন কার্যকর হবে তার কোনও দিশা দেখা যাচ্ছে না। একই ভাবে, লোকায়ুক্তের পদে নিয়োগের জন্য রাজ্যের মনোনীত প্রার্থীকেও ছাড়পত্র দেননি রাজ্যপাল। এই পক্ষাঘাতগ্রস্ত দশা চলছে কয়েক মাস ধরে।
অর্থাৎ মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নেও বিরোধী ও ক্ষমতাসীন দলগুলি যেমন মতৈক্যে পৌঁছতে পারছে না, তেমন রাজ্যপালও তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে অচলাবস্থার নিরসন করছেন না। প্রশ্ন ওঠে, কোন ব্যক্তি নিয়োগ হবেন, কী পদ্ধতিতে নিয়োগ হবে, তা নিয়ে বিরোধ কি মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপালের কাছে নাগরিকের সুবিচার পাওয়ার প্রয়োজনের চাইতেও অধিক প্রাধান্য পাবে? এ ভাবে স্বতন্ত্র কমিশনগুলি নিধিরাম সর্দার করে তোলা কেন? আশঙ্কা হয়, রাষ্ট্রক্ষমতা যেন আজ এই বার্তা দিচ্ছে যে, রাজনৈতিক শক্তিই আজ শেষ কথা। তাকে শাসন করার, তার আজ্ঞাধীন পুলিশ-প্রশাসনকে সংযত করার জন্য নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান হয় নিষ্ক্রিয় হবে, নইলে বশংবদ হয়ে থাকবে। ভয়ানক নানা ঘটনার সম্মুখে মানবাধিকার কমিশন, তথ্যের অধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন প্রভৃতির নীরবতা এই সন্দেহকেই ঘনীভূত করেছে যে, সেগুলি নামেই স্বতন্ত্র, কাজের বেলায় সরকার-অনুগামী। যে কমিশনগুলি সক্রিয়, যেমন মহিলা কমিশন বা শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন, তার সদস্যদের থেকেও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার স্বর শোনা যায়নি। বরং কখনও বিরোধী দল, কখনও কেন্দ্রীয় সরকার বা কেন্দ্রীয় নানা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনা গিয়েছে। রাজ্য সরকারের আধিকারিক বা কর্মীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সুপারিশ করেছে কোনও কমিশন, এমন সংবাদও প্রকাশিত হয়নি। বস্তুত অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুরুতর অভিযোগগুলির কী নিষ্পত্তি হচ্ছে, নাগরিকের কাছে তা অজানা থেকে যাচ্ছে।
আদালতে বিচার সময়সাপেক্ষ, সেই কারণেই আইন করে স্বতন্ত্র নানা কমিশন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলি কার্যত নিষ্ক্রিয়। রামপুরহাট অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়ানক নারীহিংসার ঘটনাতেও মহিলা কমিশনের নীরবতা আহত করেছে রাজ্যকে। তথ্যের অধিকার কমিশনে আবেদন করে প্রশাসনের থেকে তথ্য পেতে বছর ঘুরে যায়, আইন-নির্দিষ্ট সীমা প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে মানুষের আস্থাও কমছে। প্রাক্তন বিচারপতি অসীমকুমার রায় লোকায়ুক্ত থাকাকালীন তিন বছরে মাত্র ত্রিশটি অভিযোগ পেয়েছেন। কমিশনগুলি কালক্রমে হয়ে উঠছে মাটির কামান— প্রদর্শনীর সামগ্রী, ব্যবহারের নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy