পশ্চিমবঙ্গে প্রসূতি মৃত্যুর হার জাতীয় হারের থেকে বেশি, এবং স্বাস্থ্য দফতরের নানা উদ্যোগেও তা কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্টে এই তথ্য ফের ধরা পড়ল। ২০২০-২২ সময়কালের সমীক্ষার রিপোর্ট সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে এক লক্ষ জীবিত সন্তান প্রসবে প্রসূতির মৃত্যুর গড় হার ১০৫। রাজ্য যদিও দাবি করেছে যে এই পরিসংখ্যান পুরনো, এবং এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে সংবাদ, গত বছর এপ্রিল-জুন সময়কালে ওই হার ছিল ১০৩। জেলাওয়ারি প্রসূতি মৃত্যুর যে সংখ্যা রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে পাওয়া গিয়েছে, তা-ও স্পষ্ট করে দেয় যে প্রসূতি-মৃত্যুহার রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। বিশেষত কলকাতার সঙ্গে জেলাগুলির মৃত্যুহারে এত পার্থক্য কেন, সে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। কলকাতায় প্রসূতি-মৃত্যুহার যেখানে এক লক্ষে ৩৪, সেখানে কলকাতার পাশের জেলা হাওড়াতে ১২৪ কিংবা উত্তর ২৪ পরগনায় কেন ৯২? এই একটি পরিসংখ্যানই স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামোয় ভারসাম্যহীনতার প্রকৃত চিত্রটা তুলে ধরে। পরিকাঠামো এবং পরিষেবার মান নিয়ে বিশেষ চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা সাংবাদিকদের কাছে একান্তে স্বীকার করেছেন যে, অস্ত্রোপচারের দ্বারা প্রসব, বা সিজ়ারিয়ান সেকশনের পরে ঘটছে ৭০ শতাংশ প্রসূতি-মৃত্যু। যার অর্থ, অস্ত্রোপচারের পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় প্রসূতির উপর নিয়মিত নজরদারি এবং পরিচর্যায় অভাব থেকে যাচ্ছে। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের মতো জটিলতা ধরা পড়ছে যখন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রের নিয়ম অনুসারে প্রতিটি প্রসূতি মৃত্যুর বিশদ তদন্ত করে স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যগুলি থেকে প্রসূতি মৃত্যুর কোন কারণগুলি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে সাব্যস্ত হল, কিংবা তার প্রতিকারে কী পরিকল্পনা নিচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর, সে বিষয়ে কোনও তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না।
ফলে রাজ্যবাসীর হাতে থাকে কেবল সংবাদের সূত্র। দূষিত স্যালাইনে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালে এক প্রসূতির মৃত্যু এবং চার প্রসূতির গুরুতর অসুস্থতার অভিযোগ উঠেছে এ বছর। সন্দেহ জেগেছে যে, এর পূর্বে প্রসূতিমৃত্যুর নানা ঘটনার পিছনেও ছিল দূষিত স্যালাইনের সরবরাহ। রাজ্য সরকার অবশ্য অতি-পরিচিত উপায়ে সঙ্কটের গভীরে না গিয়ে ডাক্তার এবং নার্সদের উপরেই দোষ চাপিয়েছে। দূষিত স্যালাইনের উৎপাদন বা সরবরাহের জন্য কারা দোষী, সে বিষয়ে আলোচনা আড়ালে চলে গিয়েছে। রয়েছে নাবালিকা প্রসূতি নিয়ে উদ্বেগও। রাজ্য সরকারের ‘মাতৃমা’ প্রকল্পের জন্য সংগৃহীত তথ্যে নাবালিকা মাতৃত্বের ছবি জানা গিয়েছিল ২০২৩ সালেই। কিন্তু তার পরেও প্রকৃত চিত্র বদলায়নি। আঠারো বছর বয়সে বিয়ে বৈধ হলেও, সরকার মায়ের একুশ বছর বয়সকেই প্রথম প্রসবের যথাযথ বয়স বলে চিহ্নিত করেছে। আক্ষেপের বিষয় এই যে, পশ্চিমবঙ্গে প্রতি ছ’জন মায়ের এক জন ‘টিনএজার’ অর্থাৎ উনিশ বছর বা তার কম। এর ফলে নবজাতক ও প্রসূতি, দু’জনেরই নানা সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। রাজ্যে ‘কন্যাশ্রী’র মতো প্রকল্প চালু থাকলেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন চোখে পড়ছে না।
মনে রাখতে হবে, প্রসূতি মৃত্যুর হার কেবল মেয়েদের স্বাস্থ্যের একটি সূচক নয়, তা স্বাস্থ্যব্যবস্থার সার্বিক অবস্থার একটি প্রতিফলন। বিশেষ করে আপৎকালীন চিকিৎসা কার্যকর হওয়া চাই। সেই জন্যই হাসপাতালে প্রসবের নীতির উপর এত জোর দিয়েছিল ভারত। তাতে কাজও হয়েছে— ২০১৪-১৫ সালে প্রসূতি মৃত্যুর হার এক লক্ষে ১৩০ থেকে ২০২০-২২ সালে দাঁড়িয়েছে ৮৮-তে। কিন্তু রাজ্যগুলির মধ্যে, এবং এক রাজ্যের নানা জেলার মধ্যেও, চিকিৎসার পরিকাঠামো ও পরিষেবায় যে ফারাক থেকে গিয়েছে, তাতেই মরণাপন্ন হচ্ছেন অগণিত প্রসূতি। সময় থাকতে সমস্যাকে স্বীকার করে, তার সমাধানের রাস্তা খোঁজা দরকার।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)