তথ্য বস্তুটি কেবল বিশেষজ্ঞদের কাজেই লাগে, বিশ্লেষণ ও গবেষণার জন্যই তা জরুরি— ভাবলে বিরাট ভুল হবে। তথ্য আসলে সাধারণ মানুষের সম্পদ। তথ্যই বাস্তবের ছবি তুলে ধরতে পারে মানুষের কাছে। তথ্য হল গণতন্ত্রের ভিত্তি। এবং সেই কারণেই, তথ্য যদি গায়েব করা যায়, তা হলে শুধু গবেষণা-বিশ্লেষণেরই ক্ষতি নয়, বিরাট লাভ— শাসকের। নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার নিরাপদ পথ, তথ্য লোপাট করে বাস্তবের ছবিটি সাধারণ মানুষের কাছে ধোঁয়াশায় পরিণত করা। এত কথার অবতারণার কারণ, ভারতের বর্তমান রাজনীতি ও তথ্য লোপাটের সংস্কৃতি। এই উত্তর-সত্য যুগে, তথ্যের জায়গা নিয়েছে চলতি ধারণা, কিংবা আলগা অনুভব, ইংরেজিতে ‘ভাইবস’ শব্দটি এ প্রসঙ্গে বিশেষ সহায়ক। বর্তমানে রাজনৈতিক নেতারা চান, তথ্যের অনুপস্থিতিতে নাগরিক নিজের রাজনৈতিক ধারণা গঠন করুন এই আলগা ধারণা বা ভাসমান অনুভবের ভিত্তিতে। তা হলে নেতা-নেত্রীদের বড্ড সুবিধা। মানুষেরও কোনও অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই। কেননা, কে না জানে, কবিবর যা-ই বলে থাকুন, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধই থাকে। সুতরাং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্ত অনায়াসে ভাসিয়ে দিয়েছেন তথ্যের জায়গায় একটি ‘অনুভব’— এ বছর নাকি দীপাবলিতে দিল্লির সামগ্রিক দূষণ গত বছরের তুলনায় অনেকাংশে কম। পরিবেশমন্ত্রী মনজিন্দর সিংহ সিরসারও মত তা-ই।
এই গভীর আত্মতুষ্টি ও শান্তির পাশেই রাখা দরকার আর একটি গুরুতর বিষয়কে— গত কয়েক দিনে দিল্লিতে যখন মানুষ অত্যধিক দূষণের চোটে দমবন্ধ বোধ করছেন, যখন দৃশ্যতই ঘন ধোঁয়াশার চাদরে ঢেকে রাজধানী, শহরের ৩৮টি জ়োনের মধ্যে ৩৪টিতেই যখন একিউআই (বায়ুদূষণ মাপক একক) বিপজ্জনকের পর্যায়ে, সেই সময়ে দিল্লি দূষণ নিয়ন্ত্রণ কমিটি-র সরকারি ওয়েবসাইট থেকে তথ্য গায়েব হতে শুরু করেছে। দীপাবলির দিনটিতে এক বিরাট সময়ে নাকি দিল্লির ৩৯টি স্টেশনের মধ্যে কেবল ৯টি স্টেশন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বায়ুদূষণ মাত্রার তথ্য রেকর্ড করেছে। সেই নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন ঠিকই, কিন্তু ভারতবাসী এত দিনে জেনে গিয়েছেন যে এ দেশে এখন রাজনৈতিক বিরোধিতার ভবিতব্যও খানিকটা ক্ষণে ক্ষণে উধাও-হয়ে-যাওয়া তথ্যের মতোই, কখন আছে কখন নেই, কে বলতে পারে। ফলে বিলাসবহুল কক্ষে বায়ুশোধনকারী যন্ত্র পূর্ণক্ষমতায় চালিয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিশ্চিন্ত, সহাস্য বৈঠকের ছবি আপাতত প্রচারমাধ্যমে পরিব্যাপ্ত— যা দেখে নিশ্চয়ই এই কুহেলিকা-আবৃত, ‘অনুভব’-প্রদীপ্ত ভারতীয় মনুষ্যসাধারণেরও ‘চিত্ত হল রঞ্জিত’।
কেউ মনে করতে পারেন, কোভিড-কালেও কোথাও যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল— তথ্য। একই অভ্যাস রপ্ত করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও, সরকারি কর্মী নিয়োগ থেকে শুরু করে ডেঙ্গি-মৃত্যু, সবেতেই তার প্রকাশ। সাম্প্রতিক কুম্ভমেলায় পদপিষ্ট হয়ে বহু মানুষের মৃত্যুুর সময়ে উত্তরপ্রদেশ সরকারও একই পথ নেয়। অনেক পীড়াপীড়ির পর ‘সরকারি’ মতে ৩০ জন মৃত জানানো হয়, যেখানে খালি চোখেই মৃত্যুর পরিমাণ অনেক বেশি। বেসরকারি সূত্রে তা জানা যেতে শুরু করার পরও সরকারি সূত্র নিজেদের সংশোধন করেনি। মানতে হয়, তাদের সিদ্ধান্তের পিছনে ‘যুক্তি’ ছিল, কেননা আদৌ কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাননি— না পায়ের চাপে অগণিত মানুষের প্রাণবিয়োগ নিয়ে, না কত জন মানুষের প্রাণ গেল সেই সংখ্যা না জানতে পারা নিয়ে। দেশের বাইরে যদি কেউ মাথা ঘামান? অবশ্যই তা ‘ভারতবিরোধী চক্রান্ত’, ঠিক যেমন ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’-এ যখন দেখা গেল ১২৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৫, তৎক্ষণাৎ সরকারি মত শোনা গেল— ‘বিকশিত ভারত’ কর্মসূচিকে কালিমালিপ্ত করার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টারই অংশ ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’-এর তথ্য। অনুভবই সব, তথ্য মিথ্যা: এই হল ভারতবিকাশের নতুন ঘরানা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)