গার্হস্থ হিংসা প্রতিরোধে ২০০৫ সালের আইনটির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোকদের হাত থেকে মেয়েদের সুরক্ষা প্রদান। শুধুমাত্র আইন প্রণয়নই নয়, কোন ধরনের হিংসাকে এই আইনের আওতাভুক্ত করা যাবে, আক্রান্ত মেয়েরা কার কাছে যাবেন, কী সাহায্য পাবেন, তারও বিস্তারিত নির্দেশ দেওয়া ছিল এই আইনে। অথচ, প্রায় দু’দশক পেরোতে চলল, আইনের সুবিধাগুলি সকল আক্রান্ত মহিলার কাছে পৌঁছয়নি। সম্প্রতি দেশের শীর্ষ আদালতের বক্তব্যেও সেই কথারই সমর্থন মেলে। এক অসরকারি প্রতিষ্ঠানের আবেদনের শুনানির পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন এবং বিচারপতি সতীশ চন্দ্র শর্মার বেঞ্চ গার্হস্থ হিংসায় আক্রান্তদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেন্দ্র, রাজ্য, এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকারকে সাত দফা নির্দেশিকা দিয়েছে। ছ’সপ্তাহের মধ্যে রক্ষাকারী অফিসারদের চিহ্নিত ও নিয়োগ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, আক্রান্তদের আইনি সুরক্ষা ও বিনামূল্যে আইনি সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সচেতনতার প্রসার, পর্যাপ্ত শেল্টার হোমের ব্যবস্থা করাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
লক্ষণীয়, ২০০৫ সালের আইনটিতেও সরকার কর্তৃক রক্ষাকারী অফিসার নিয়োগের কথা বলা হয়েছিল, যাঁরা আক্রান্ত মহিলার সুবিচার পাওয়ার পথটিতে সহায়তাকারীর ভূমিকা পালন করবেন। রাজ্যগুলিকে ‘ওয়ান স্টপ সেন্টার’ চালুর প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল, যেখানে নির্যাতিতা নানাবিধ সাহায্য পেতে পারেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ-সহ অনেক রাজ্যই তাতে অগ্রসর হতে পারেনি। গার্হস্থ হিংসার ক্ষেত্রে একটি হেল্পলাইনের প্রয়োজনীয়তার কথাও বহু আলোচিত। নির্ভয়া কাণ্ডের পর জাতীয় স্তরে একটি হেল্পলাইন নম্বর চালু হয়। কিন্তু অনেক রাজ্যই তা কার্যকর করেনি। অথচ, গার্হস্থ হিংসার চিত্রটি উদ্বেগজনক। পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, আঠারো থেকে ঊনপঞ্চাশ বছরের বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে ৩২ শতাংশই স্বামীর হাতে নির্যাতিত হন। এঁদের মধ্যে ২৯ শতাংশ শারীরিক ও যৌন হিংসার শিকার।
গার্হস্থ হিংসা একটি সামাজিক রোগ, যাকে এ দেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সযত্নে লালন করে চলেছে। আক্রান্ত মহিলার অভিযোগকে ‘ছোট ব্যাপার’, ‘বাড়ির ব্যাপার’ বলে অগ্রাহ্য করেছে পুলিশ। ‘মানিয়ে নেওয়া’র চাপ এসেছে পরিজনদের কাছ থেকেও। এ সমাজে এখনও বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে স্ত্রী’র দেহ ও মনের উপর স্বামীর একচ্ছত্র অধিকারটি স্বীকৃত। বিবাহিত মেয়ের সুরক্ষায় শক্তিশালী আইনের পাশে প্রশাসনিক সক্রিয়তা ও সদিচ্ছার একান্ত প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রশাসন এই সমাজেরই অংশ। সেই জন্য গার্হস্থ হিংসা প্রতিরোধে কথা ও কাজের ফারাকটি সুবিশাল হয়ে দাঁড়ায়। সেই জন্য এখনও বৈবাহিক ধর্ষণকে ‘অপরাধ’ পর্যায়ভুক্ত করতে তীব্র আপত্তি আসে প্রশাসনের তরফ থেকেই। এখানেই বিচার বিভাগের এগিয়ে আসার গুরুত্বটি নিহিত। গার্হস্থ হিংসার ক্ষেত্রে শীর্ষ আদালতের নির্দেশিকা ও সময়সীমা বেঁধে দেওয়া কী করতে হবে-র চেয়েও কী করা হয়নি-র খতিয়ান ফুটিয়ে তোলে। প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়ে বৈবাহিক ধর্ষণকে ‘ধর্ষণ’ বলেই অভিহিত করে কর্নাটক ও গুজরাত হাই কোর্ট। আশা যে এখনও মরেনি, নারীসুরক্ষা বিষয়ে বিচার বিভাগের উদ্বেগ ও উদ্যোগ সেই সাক্ষ্যই বহন করছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)