E-Paper

নির্বোধ আস্ফালন

নাগপুরের পাঠশালায় বহুত্ববাদ শেখানোর চল নেই বটে, কিন্তু যিনি এই আক্রমণের সংগঠক, এবং যিনি তার তাত্ত্বিক পৃষ্ঠপোষক, দু’জনের কেউই আদিতে নাগপুরের পাঠশালার পড়ুয়া নন।

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২৫ ০৬:১৪

কলকাতায় যুদ্ধবিরোধী মিছিলের উপরে বিজেপির যে নেতা-কর্মী-সমর্থকরা চড়াও হলেন, তাঁদের আচরণ অসহনীয় রকম কদর্য না হলে বলা যেত যে, তাঁদের মধ্যে একটা শিশুসুলভ সারল্য রয়েছে। যুদ্ধের বিরোধিতায় মিছিল, তা হলে নিশ্চয়ই এই মিছিলকারীরা ভারতের শৌর্য আর বিক্রমের বিরোধী, অর্থাৎ নির্জলা পাকিস্তানপন্থী— এই ভাবনার মধ্যে কোথায় কোথায় ভুল থাকতে পারে, আর কোথায় বোধহীনতা, মিছিল আটকাতে পোড়া মোবিল হাতে রাস্তায় নামা ‘রাষ্ট্রবাদী’দের সে কথা বোঝার সামর্থ্য নেই। যে নেতা এই কদর্যতার সপক্ষে বাগ্‌বিস্তার করেছেন, দৃশ্যত তাঁর যুক্তিবোধও অত দূর নাগাল পায় না। নাগপুরের পাঠশালায় বহুত্ববাদ শেখানোর চল নেই বটে, কিন্তু যিনি এই আক্রমণের সংগঠক, এবং যিনি তার তাত্ত্বিক পৃষ্ঠপোষক, দু’জনের কেউই আদিতে নাগপুরের পাঠশালার পড়ুয়া নন। রাজ্য রাজনীতির স্রোত-প্রতিস্রোত তাঁদের বিজেপির কূলে ভাসিয়ে এনেছে। অবশ্য, নিজের মতের বাইরেও যে কোনও মত থাকতে পারে, এবং সে মতটি ক্ষেত্রবিশেষে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হতে পারে, এ কথাটি বুঝতে না পারার অক্ষমতা ভারতের গৈরিক জাতীয়তাবাদীদের একচেটিয়া নয়, দুনিয়া জুড়েই দক্ষিণপন্থার সমর্থকরা কথাটি বুঝতে নারাজ, এবং অপারগ। অতএব, সন্ত্রাসবাদের প্রতি সুগভীর ঘৃণা পোষণ করেও, সেই সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রশক্তির প্রতি সম্পূর্ণ বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও যে কেউ যুদ্ধের বিরোধী হতে পারেন, গৈরিক জাতীয়তাবাদী বীরপুঙ্গবেরা সে কথা বোঝেননি। এবং, নিজেদের না-বোঝা জাহির করতে রাস্তায় নেমেছেন। দুর্ভাগ্য, ইদানীং এই নির্বোধের আস্ফালনই রাজনীতি নামে পরিচিত।

মুখে যতই ‘রাষ্ট্রবাদী’ হোন, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রতি গৈরিক জাতীয়তাবাদীদের গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে, এমন অভিযোগ কেউ কখনও করেনি। ফলে, সংবিধান যে প্রতিটি নাগরিককে মতপ্রকাশের অধিকার দিয়েছে, এই ‘রাষ্ট্রবাদী’রা সে কথার তোয়াক্কা করেন না। তাঁদের স্থানীয় নেতা অসম দাওয়াই প্রয়োগের হুমকি দিয়েছেন। অবশ্য, শুধু অসম কেন, উত্তরপ্রদেশ থেকে মহারাষ্ট্র, দেশের বহু বিজেপি-শাসিত রাজ্যেই এখন গণতান্ত্রিক বহুস্বরকে দমন করার সেই দাওয়াই সহজলভ্য। পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা এখনও শাসনক্ষমতা থেকে বহু দূরে, ফলে আস্ফালনই সার। এই গৈরিক জাতীয়তাবাদীদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, যে বিষাক্ত পৌরুষ-মণ্ডিত একশৈলিক কল্পনাকে তাঁরা ‘ভারত’ বলে চালাতে চান, দেশটি আসলে সে রকম নয়। সংবিধান দেশের নাগরিককে যে অধিকার দিয়েছে, তা প্রয়োগ করা, এবং তাকে রক্ষা করার কাজটিকে তাঁরা ‘দেশ-বিরোধিতা’ হিসাবে দেখাতে চান বটে— কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁদের রাজনীতিই ভারতের ধারণাটির বিরোধী।

মিছিলে হামলা হওয়ার পর কলকাতা পুলিশ মিছিলকারী এবং হামলাকারী, দু’পক্ষকেই আটক করে, এবং পরে দু’পক্ষকেই ছেড়ে দেয়। সমদর্শিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করার বাসনা ছিল কি? মিছিলকারীদের দাবি অনুসারে, তাঁরা পুলিশের অনুমতি নিয়েই মিছিল করছিলেন। তা যদি হয়, তবে নাগরিকের শান্তিপূর্ণ ভাবে মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকারটিকে রক্ষা করাই পুলিশের একমাত্র কর্তব্য ছিল। হামলাকারীদের প্রতিহত করা প্রয়োজন ছিল। তাঁদেরও মত প্রকাশের অধিকার বিলক্ষণ রয়েছে। যাঁরা যুদ্ধবিরোধী মিছিল করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যত ক্ষোভ আছে, সব উগরে দেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার তাঁদেরও রয়েছে। কিন্তু, সেই প্রকাশের ভঙ্গিটিও গণতান্ত্রিক হওয়া অপরিহার্য। পুলিশের কর্তব্য ছিল হামলাকারীদের পান্ডাকে এই কথাগুলি বুঝিয়ে বলা। তার পরিবর্তে পুুলিশ যে ভূমিকা গ্রহণ করল, তাতে স্পষ্ট যে, নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার সম্বন্ধে আইনরক্ষা বাহিনীরও ধারণা বিশেষ স্পষ্ট নয়। এই ব্যর্থতার দায় বহন করবে কে?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP Kolkata Police Nationalism Left Pahalgam Terror Attack Operation Sindoor

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy