যোগ্য বনাম অযোগ্য— এই একটি শব্দবন্ধ এখন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নানা ক্ষেত্রে নানা প্রহেলিকা তৈরি করেছে। শিক্ষাজগতের গোলকধাঁধাটির সঙ্গে সবে যখন রাজ্যবাসী পরিচিত হয়ে উঠছেন, এমন সময়ে আবার আর এক ব্যাপকতর যোগ্য-অযোগ্য প্রহেলিকায় তাঁদের সম্বিৎ হারানোর দশা। এ বারের ক্ষেত্র ভোটার কার্ড। ভোটার তালিকায় কারচুপি কোনও নতুন বিষয় নয়, পশ্চিমবঙ্গে এই বাস্তব অনেক দশকের পুরনো, সারা দেশেও যথেষ্ট প্রচলিত ও প্রসারিত এই ‘প্রথা’। শোনা যাচ্ছে, এই রাজ্যে ভুয়ো ভোটারের ব্যাপকতা বিশেষ রকম বেশি, আলগা সীমান্তের কারণে। ‘ভুয়ো’-দের তালিকায় ঢোকাতে ক্ষুদ্র মাঝারি বৃহৎ সব স্তরের বন্দোবস্তকারীরা এতই ব্যস্ত যে, অনেক ক্ষেত্রে নাকি বাদ পড়ে যাচ্ছেন যোগ্যরাই। গত কয়েক বছর ধরেই এনআরসি-সিএএ সূত্রে ভোটার তালিকার বিষয়টি প্রশাসনিক নজর আকর্ষণ করছে। তবে সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সঙ্কট উপস্থিত হওয়ায় এ বার জরুরি ভিত্তিতে নড়েচড়ে বসেছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। কমিশন-কর্তাদের কাছে জমা হচ্ছে অভিযোগের পাহাড়। যার অধিকাংশেরই বক্তব্যের মধ্যে একটি সাধারণ নকশা পরিস্ফুট। ভোটার তালিকায় নাম তোলা, সংশোধন করা, বাদ দেওয়ার দায়িত্বে খোদ জেলশাসকের অধীনে জেলা স্তরের যে আধিকারিকরা আছেন, তাঁদেরই তত্ত্বাবধানে অনলাইন ব্যবস্থায় কাজটি হয়ে আসছে। দীর্ঘ সময় ধরেই নাকি সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যারে নানা ফাঁক থাকার কারণে অবৈধদের নাম ‘ঢুকে পড়ছে’, এবং অনেক ক্ষেত্রে বৈধদের নাম ‘বাদ পড়ছে’। কাজটিকে পরস্মৈপদী হিসাবে পেশ করার অনেক রকম সুবিধা, স্বভাবতই, তাতে দায়গ্রহণ এবং দায়িত্বস্খলনের চাপ থাকে না। এই কর্মকাণ্ড যে নানা দিক দিয়েই সঙ্কট সৃষ্টিকারী, তা আর বলে দেওয়ার দরকার নেই।
দরকার নেই এই সত্য পুনরাবৃত্তিরও। বাংলাদেশে ভারতীয় ভোটার কার্ড এবং আধার কার্ডের যে বিস্তৃত জালিয়াতি চক্র ছড়িয়ে আছে, তার জেরে পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকা সুষ্ঠু ও বৈধ রাখার লক্ষ্যটি অসম্ভব কঠিন। অথচ, যথার্থ তদন্ত করার পরিসর থাকলে সন্দেহভাজনের তালিকাটিও বেশ দীর্ঘ হত। প্রশ্ন করা যেত, কেন এত মানুষ পরিণত বয়সে প্রথম বার ভোটার হতে এসেছেন। কিংবা কেন এক ব্যক্তির নানা নামে নানা ভোটার কার্ড থাকছে। কেন এক নামে এত ভোটার কার্ড থাকছে। কেন স্বাভাবিক জীবৎকাল অতিক্রম করে যাওয়া ভোটারদের নামও তালিকাভুক্ত থেকে যাচ্ছে। নির্বাচনী আধিকারিকদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার কাজটি সহজ হচ্ছে যে-হেতু বিভিন্ন স্তরে আধিকারিকদের মধ্যে সমন্বয়ের সুযোগ কম। এবং, অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাবেই, রাজনীতিকদের হস্তক্ষেপ বেশি।
প্রসঙ্গত উঠে আসে আরও একটি জরুরি বিষয়। সম্প্রতি মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক হামলা ও পহেলগামে জঙ্গি হানার ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ-সীমান্ত সমস্যাটি গোটা দেশের কাছেই নতুন করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রেও সঙ্কট পরিস্থিতির সমর্থন মিলেছে। কেবল সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নয়, পাক গুপ্তচর সংস্থার নজরেও যে এই ছিদ্রময় সীমান্ত বিশেষ সুবিধাজনক, তা এখন আগের থেকে অনেক বেশি উৎকণ্ঠার কারণ। রাজ্যের ভুয়ো-ভোটার সমস্যাটি অনেকাংশে এর সঙ্গে জড়িত, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই তা জানিয়ে সতর্ক করেছেন। শিলিগুড়ির ‘চিকেন্স নেক’ বিষয়ে তিনি আধিকারিকদের আলাদা করে জানিয়েছেন। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যুগপৎ সক্রিয়তা ও অতি সমন্বিত সহযোগিতা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব। বিলম্বে হলেও সেই সচেতনতা অবশেষে পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লিতে লক্ষিত হচ্ছে, বিষয়টিতে যথাযোগ্য গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, এটাই এই মুহূর্তের সুসংবাদ। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এই সংযোগ ও সতর্কতা একই ভাবে জারি থাকলে তা হবে আর একটি বড় সুসংবাদ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)