শেষ অবধি মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হল। গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসনের বিষয়টি সাধারণ ভাবে বাঞ্ছনীয় না হলেও মণিপুরে গত সাড়ে ছ’শো দিন ধরে যে ভয়ানক পরিস্থিতি চলছে, তার গুরুত্ব বিচারে হয়তো এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। প্রসঙ্গত, ইতিপূর্বে মণিপুরে অনেক বার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছে ও প্রত্যাহৃত হয়েছে। অবশ্যই এই বারের পরিস্থিতি— অদৃষ্টপূর্ব, ঐতিহাসিক। কুকি-জ়ো, মেইতেই এবং অন্যান্য জনজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত যে পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, তাতে কোনও ‘সন্তোষজনক’ মীমাংসার মাধ্যমে মণিপুর অদূর ভবিষ্যতে স্থিত ও শান্ত থাকবে, এ প্রত্যাশা করাই কঠিন। তবু নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সকল প্রস্তুতি শেষ করে রাষ্ট্রপতি শাসনের শিকল থেকে রাজ্যে আবার নির্বাচন করা সম্ভব হবে, এই আশা করা ছাড়া হাতে কিছু নেই। আশাটির বাস্তবায়ন একটি অসম্ভব দুরূহ কাজ, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিস্থিতি হয়তো কিছুটা স্বাভাবিক করা যাবে, হিংসার প্রচণ্ড তাণ্ডব রোধ করা যাবে।
একটি প্রশ্ন না উঠিয়ে পারা যায় না। এত জরুরি একটি কাজে এত বিলম্ব কেন? মুখ্যমন্ত্রীর আসন থেকে এন বীরেন সিংহের পদত্যাগের সংবাদে এই প্রশ্নই যে কোনও শুভবোধসম্পন্ন নাগরিককে পীড়িত করেছে। মণিপুর রাজ্যটি তাঁর চোখের সামনে জ্বলেপুড়ে বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছে, কত মানুষ বাড়িঘর ও সর্বস্ব হারিয়েছেন, কত মানুষ স্বজনবিয়োগের বেদনায় ভাষাহারা হয়ে গিয়েছেন, শিশু-যুবা-বৃদ্ধ নির্বিশেষ নির্যাতিত হয়েছেন, কত নারী সম্মান হারিয়ে যন্ত্রণাকাতর জীবন অতিবাহন করছেন। গত দুই বছর ধরে এই ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী থেকেছে দেশবাসী, এবং, অবশ্যই এন বীরেন সিংহ। অতি-বিলম্বিত পদত্যাগের আগে তিনি ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন মণিপুরবাসীদের কাছে। এই ক্ষমাপ্রার্থনা শুনিয়েছে পরিহাসের মতো। রাজ্যের মানুষকে বাঁচানোর কাজটি যাঁর করার কথা ছিল, যাঁর কাজ ছিল দরকারে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য নিয়ে যে কোনও ভাবে আইনের শাসন ফিরিয়ে আনা— আজ কোনও ক্ষমাপ্রার্থনাতেই কি তিনি তাঁর হিমালয়সমান ব্যক্তিগত দায়টিকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন? পদত্যাগের মধ্যে নীতির চেতনা বা বিবেকের দংশনের থেকে অনেক প্রকট রাজনীতির চাপ। তিনি তাঁর আসন ছেড়ে দিলেন, কিংবা তাঁকে আসন ছাড়তে বাধ্য করা হল রাজনৈতিক বেগতিক দেখেই। কিছু কাল ধরেই মণিপুরের শাসক দল বিজেপির মধ্যে বিক্ষোভের বিস্ফার দেখা যাচ্ছে, এন বীরেন সিংহের বিরুদ্ধ গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিরোধী কংগ্রেস ইতিমধ্যে বিধানসভায় নো-কনফিডেন্স মোশন আনার প্রস্তাব দেয়। বুঝতে বাকি থাকে না, সরকার কঠিন প্যাঁচে পড়তে চলেছে, যে-হেতু বিক্ষুব্ধ বিজেপি নেতারা বঙ্কিম চাল খেলে দলের বিপক্ষে যেতে দ্বিধা বা দেরি করবেন না। ফলে তড়িঘড়ি পদত্যাগ করে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানো জরুরি হয়ে পড়ল।
রাষ্ট্রপতি শাসন জারির পর কী ভাবে মণিপুরে মেইতেই ও কুকি-জ়ো’সহ বিবদমান জাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে বোঝাপড়ার চেষ্টা চলবে, তার দিকেই এখন তাকিয়ে আছে দেশ। এখনও যে কোনও শান্তি আলোচনার প্রস্তাব এলেই রাজ্যপাল অজয় ভল্লা-র কাছে আবেদনপত্র জমা পড়ছে এই শর্ত-সহ যে— কুকি প্রমুখ গোষ্ঠীকে জনজাতি সংরক্ষণ তালিকা থেকে বাদ দিলে একমাত্র তবেই শান্তিপ্রক্রিয়ায় অগ্রসর হওয়া যাবে। নতুবা আবারও সমগ্র রাজ্যে রক্তস্নানের বন্যা বইবে। একই সঙ্গে চলছে ব্যাপক প্রচার: কুকিদের বেআইনি অধিবাসী বলে দাগিয়ে দিয়ে ভূমিপুত্র জাতিগুলির দাবি সরকারকে মানতে বাধ্য করার চাপ আসছে নানা দিক থেকে। সংশয়ের বিস্তর কারণ যে, সমাধানের দিকে এক পা এগোনো গেল মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে পরিস্থিতি এখনও প্রবল বিপজ্জনক, এগোনোর বদলে পা রয়েছে স্থির। সমাধান হয়তো এখনও সুদূর, এমনকি অধরা।