ভারতে বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একেবারে প্রথম সারিতে থাকবেন, তাতে সন্দেহ নেই। নীতি আয়োগের পরিসরে বিজেপি বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলির প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করে, সেই অভিযোগটিও মেনে নেওয়া যায়। যেমন, বিগত এক বৈঠকের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন যে, বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীরা যেখানে নিজেদের বক্তব্য পেশ করতে সময় পেয়েছিলেন পনেরো মিনিট করে, সেখানে তাঁকে সময় দেওয়া হয়েছিল মাত্র পাঁচ মিনিট। কিন্তু, সব যুক্তি মেনে নেওয়ার পরও প্রশ্ন— মুখ্যমন্ত্রী নীতি আয়োগের গভর্নিং কাউন্সিল-এর বৈঠকে যোগ না দেওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের কতখানি লাভ হল? উত্তরটি জানা— লাভের ঘরে শূন্য। তাঁর আগমার্কা বিজেপি-বিরোধিতার নজির হিসাবে নীতি আয়োগের বৈঠক বয়কট করার ঘটনাটি ভোটের বাজারে কতখানি কার্যকর হবে, সে হিসাব ভিন্ন; কিন্তু, এই বয়কটের সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে রাজ্যের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মৌলিক শর্তটি পালনের পরিপন্থী। এ কথা ঠিক যে, তিনি একা নন— আরও দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কাউন্সিলের এই বৈঠকে যোগ দেননি। তাঁদের এক জন সিপিএমের— কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন; অন্য জন কংগ্রেসের— কর্নাটকের সিদ্দারামাইয়া। অর্থাৎ, ভারতের বিজেপি-বিরোধী পরিসরে যে দু’টি দলের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোটে বনে না, নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তে তিনি তাঁদের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে বসলেন।
কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে, বৈঠকে যোগ দিয়েই বা রাজ্যের কী উপকার হত? গত এগারো বছরে আর্থিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে প্রবল ভাবে। অর্থ কমিশনের সুপারিশ ছিল যে, কেন্দ্রীয় কর রাজস্ব আদায়ের ৪১% পাবে রাজ্যগুলি; সেখানে গত চার বছরে এই অনুপাত এসে দাঁড়িয়েছে ৩৩ শতাংশে। তার উপরে, অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্পই এখন কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ অর্থ বরাদ্দে চলে। ফলে, রাজ্যগুলির উপরে আর্থিক বোঝা বিপুল। অন্য দিকে, কারণে-অকারণে বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলিতে বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ পাঠানো বন্ধ করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই বিষয়গুলিতে বিরোধী রাজ্যের আপত্তি কেন্দ্রীয় সরকার আদৌ গ্রাহ্য করেনি— বরং, প্রশাসনিকতাকে নিয়ে এসেছে রাজনৈতিক স্তরে। ফলে, প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, নীতি আয়োগের মতো দৃশ্যত পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিষ্ঠানের বৈঠকে যোগ দিয়ে, নিজেদের বক্তব্য পেশ করার মতো যথেষ্ট সময় না পেয়ে, মুখ্যমন্ত্রী এমন কী বলতে পারতেন, যাতে রাজ্যের স্বার্থ রক্ষিত হত?
এই প্রশ্নের একটি উত্তর পাওয়া গেল পর্ষদের বৈঠকেই। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতা ইদানীং বেশ চড়া তারে বাঁধা। তার পরেও তিনি বৈঠকে যোগ দিয়েছেন, এবং বক্তৃতায় নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। বলেছেন, ভারতকে ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার মাপের অর্থব্যবস্থা হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্নে তাঁর রাজ্যও শরিক। এবং, সেই কারণেই জোর দিতে হবে আর্থিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার উপরে— যাতে অর্থাভাবে রাজ্যগুলির বৃদ্ধির প্রক্রিয়া ব্যাহত না হয়। যে ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষার অধিকার আইনের অধীনে রাজ্যের ২২০০ কোটি টাকা আটকে রেখেছে, তাতে নিজের আপত্তির কথা জানিয়েছেন স্ট্যালিন। একই সঙ্গে বিরোধিতা করেছেন হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ারও। নীতি আয়োগের পরিসরে এই কথাগুলি বলার প্রত্যক্ষ লাভ কতখানি হবে, তা অদূর ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। কিন্তু, কথাগুলি বলার রাজনৈতিক লাভ হল সর্বভারতীয় পরিসরে বিজেপির উপরে আরও এক দফা চাপ তৈরি করা। তাকে কেন্দ্র করেও অগ্রসর হতে পারে জোট-রাজনীতি। সম্ভাব্যতার শিল্প রাজনীতি— কিন্তু, সেই সম্ভাবনাগুলি তৈরির জন্য সচেষ্ট হওয়া বিধেয়। গোসা করে দূরে থাকলে কী ভাবে চলবে?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)