শেষ অবধি তবে কী দাঁড়াল— প্রচুর ওষুধ খেতে হয় বলে যন্ত্রমেধার মাথা গরম, না কি এমনিতেই ব্রেনে অক্সিজেন পৌঁছয় না? আরও বড় প্রশ্ন, যন্ত্রমেধাই যদি বোলপুরের আইসি-কে ফোন করে গালিগালাজ করে, তার জন্য অনুব্রত মণ্ডল ক্ষমাপ্রার্থনা করে দু’দু’খানা চিঠি লিখবেন কেন? ইদানীং তো যে চিঠি নিজের লেখার কথা, অনেকে সেগুলোও যন্ত্রমেধাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছেন— আর এ দিকে অনুব্রত যন্ত্রমেধার হয়ে চিঠি লিখে দিচ্ছেন, তা-ও নিজের নামে? এ সব তর্কের মধ্যে কারও কারও মনে পড়তে পারে অনতিঅতীতের কথা— অনুব্রতবাবুর মুখে কখনও শোনা গিয়েছিল পুলিশকে বোমা মারার কথা, বিরোধীদের নকুলদানা, গুড়-বাতাসা খাওয়ানোর কথা; কখনও আবার দেখা গিয়েছিল যে, তিনি পুলিশকে সময় বেঁধে দিয়ে বলছেন, এর মধ্যে সবাই গ্রেফতার না হলে তিনি ‘ভয়ঙ্কর খেলা’ খেলে দেবেন। তখনও বীরভূমের আকাশে তিনিই তৃণমূল কংগ্রেসের মুক্তিসূর্য— যদিও ২০২৪-এর ভোট প্রমাণ করে দিল যে, তিনি জেলে থাকলেও বীরভূমের দু’টি আসনেই তৃণমূল হইহই করে জিততে পারে। ফলে সে দিন এ সব কথা বলার জন্য তাঁকে বকুনিও খেতে হয়নি, ক্ষমাপ্রার্থনাও করতে হয়নি। কিন্তু আজ কি এ কথা ভেবে দেখা যায় না, তখন যাঁকে অনুব্রত বলে মনে হয়েছিল, তিনিও ‘ভার্চুয়াল রিয়ালিটি’ মাত্র— এমন এক অনুব্রত মণ্ডল, যাঁর উপস্থিতি এবং সক্রিয়তা সম্ভব হয়েছিল কেবলমাত্র স্রষ্টার অঙ্গুলি নির্দেশে?
স্রষ্টার অঙ্গুলির কথা বিবেচনার বাইরে রাখা মুশকিল, কেননা এই বিশেষ দলটি এতই এক-মুখাপেক্ষী। ফলত অনুব্রত মণ্ডল এই মুহূর্তে একটি গভীরতর প্রশ্নের দ্যোতক— তিনি কে? তিনি কি কেবল তিনিই? এর উত্তরটি নিশ্চিত— অনুব্রত এক রাজনৈতিক নির্মাণ। দুর্গাকে যেমন ইন্দ্র দিয়েছিলেন বজ্র, বরুণ দিয়েছিলেন শঙ্খ, মহাদেব ত্রিশূল, আর ব্রহ্মা দিয়েছিলেন পদ্ম— তেমনই, অনুব্রতর তেজও তাঁর উপরে আরোপিত। এবং একক বলে আরোপিত। রাজ্যবাসী অভিজ্ঞতায় জানেন, অনুব্রত একাই নন; রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে রয়েছেন এমনই বহু অবতার— যাঁদের প্রবল প্রতাপে ভস্ম হয়ে যায় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা। নিজস্ব তালুকে তাঁদের কথাই আইন, তাঁদের ইচ্ছাই সংবিধান। কিন্তু, তার কোনও তেজই তাঁদের নিজস্ব নয়, আরোপিত। আজকের প্রযুক্তির ভাষায় বললে, তাঁরা চ্যাটবটমাত্র— ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রেনিং করে দেওয়া, প্রম্পট এঞ্জিনিয়ারিং দ্বারা চালিত। সেই প্রম্পট কোথা থেকে আসে, তা যথার্থ ভাবে অনুমান করার জন্য কোনও পুরস্কার নেই।
আধুনিক সভ্যতার এক চরম সত্য হল, আজ যা অতি মহার্ঘ উপকরণ, কাল তা-ই নিতান্ত বর্জ্য। সর্বশক্তিমান মোবাইল ফোন যার উদাহরণ— কয়েক বছরের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে তার ঠাঁই হয় আবর্জনার স্তূপে। সেই বর্জ্য এখন পৃথিবীর গভীর সঙ্কটের কারণ— তার থেকে ছড়ানো বিষক্রিয়ায় দূষিত হচ্ছে মাটি, জল, বায়ু। রাজনৈতিক বর্জ্যের ক্ষেত্রেও ছবিটি খুব পৃথক নয়, বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল-শাসিত পশ্চিমবঙ্গে। সেই পশ্চিমবঙ্গে এও সত্য যে, এই পরিবর্তনশীলতার দুনিয়ায় সবই প্রতিস্থাপনযোগ্যও বটে। তেমনই, বীরভূমের রাজনৈতিক বৃত্তও ক্রমপরিবর্তনশীল, পুরনো নেতা সেখানে অপরিহার্য নন, বরং তার উল্টোটাই— সেখানেও প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে প্রযুক্তিমানবেরও সমস্যা প্রযুক্তি দুনিয়ার মতোই: বাতিল পুরনো যন্ত্রটির প্রয়োজন ফুরোলেও অনেক সময় তার তেজস্ক্রিয় চরিত্র পাল্টায় না, তার বিকিরণ ঘটতেই থাকে। সে ঝঞ্ঝাট সামলানোর উপায় কী, প্রযুক্তিমানবের উদ্ভাবকরা এখনও তা নিয়ে নিশ্চিত নন। ১৮১৮ সালে মেরি শেলির লেখা কিংবদন্তি উপন্যাসটি বুঝিয়ে দিয়েছিল, ‘সামলানো’র কাজটি কত কঠিন। সেই উপন্যাসে ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন শেষ অবধি নিহত হয়েছিলেন তাঁরই সৃষ্ট দানবের হাতে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)