যাঁদের চাকরি জোটেনি, অথবা যাঁরা কাজ খুইয়েছেন, ভারতের এই অমৃতকালে তাঁরা কেমন আছেন সে কথা অনুমান করা চলে। কিন্তু, যাঁদের চাকরি আছে, তাঁরাও কি খুব ভাল আছেন? অন্তত সেই সব মানুুষ, যাঁরা সরকারি চাকরি করেন না, পে কমিশনে যাঁদের নিশ্চিত বেতনবৃদ্ধি ঘটে না, অথবা নিয়মিত মহার্ঘ ভাতা বাড়ে না যাঁদের? নীতি আয়োগের সদস্য অর্থনীতিবিদ অরবিন্দ ভিরমানি সম্প্রতি এমন চাকরিজীবী মানুষের কথা উল্লেখ করলেন। বললেন, পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে-র পরিসংখ্যান অনুসারে দেশে কর্মসংস্থান বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু যাঁরা চাকরি করেন, গত কয়েক বছরে তাঁদের বেতনবৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মূল চরিত্র কী, বিনা বেতনে পারিবারিক ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের ফলেই তার বৃদ্ধি ঘটছে কি না, এই প্রশ্নগুলি সাম্প্রতিক কালে বহু আলোচিত। কিন্তু, চাকরিজীবী মানুষের বেতনের অকিঞ্চিৎকর বৃদ্ধির সমস্যাটি আলোচনায় তেমন ঠাঁই পায় না। বেতনবৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারার অর্থ, অধিকাংশ চাকরিজীবী মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। অর্থাৎ, তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। অনুমান করা চলে, এই ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে পরিবারের উন্নয়নে— পুষ্টিকর খাদ্য থেকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সব ক্ষেত্রেই ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন এই শ্রেণির মানুষ। ভারতের মতো পিতৃতান্ত্রিক দেশে এই ব্যয় হ্রাসের বোঝা বিসদৃশ ভাবে পড়ে মেয়েদের উপরে, ফলে তাঁদের উন্নয়ন আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আরও কিছু বছর পরে সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচকগুলিতে ক্রমে ধরা পড়বে এই ছবিগুলি। কিন্তু, এই মুহূর্তে চাকরিজীবী শ্রেণির বিপন্নতার সংবাদটি স্বীকার করে অরবিন্দ ভিরমানি একটি উপকার করলেন— এত দিন যে কথা অন্য লব্ধপ্রতিষ্ঠ অর্থশাস্ত্রীরা বলতেন, এ বার সরকারি মহলে তার প্রতিধ্বনি শোনা গেল।
যাঁরা বেসরকারি চাকরি করেন, তাঁদের মাইনে কী গতিতে বাড়ছে, তার স্পষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া মুশকিল। কিন্তু, তাঁদের সমস্যার বহুবিধ ইঙ্গিত দীর্ঘ দিন ধরেই মিলছে। ভারতের বাজারে এক অতিবৃহৎ ভোগ্যপণ্য বিক্রেতা সংস্থার কর্ণধার চাহিদাভঙ্গের অভিযোগ করেছিলেন কিছু দিন আগে— চাকরিজীবী শ্রেণির আয় ধাক্কা না খেলে এমন চাহিদাভঙ্গ ঘটত না। আবাসন থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে যে, উপরের দিকের পণ্যের চাহিদা যখন বাড়ছে, তখনও তুলনায় কম দামি পণ্যের বাজার দুর্বল। অর্থাৎ, আয় ধাক্কা খেয়েছে তাঁদেরই, যাঁদের এমনিতেই আয় কম। ভারতে আর্থিক বৈষম্য কোন স্তরে পৌঁছেছে, টমাস পিকেটির রিপোর্টে তা স্পষ্ট। অর্থব্যবস্থায় সেই বৈষম্যের প্রবেশের অন্যতম পথ কাজের বাজার। তবে, শ্রীভিরমানি রোগটিকে চিহ্নিত করতে পারলেও তার কারণ বুঝতে ভুল করেছেন। কর্মীদের নিম্ন উৎপাদনশীলতা সমস্যার কারণ নয়— বরং, তা এই ব্যবস্থার এক গোত্রের ফল— সমস্যার মূলে আছে অর্থব্যবস্থার সামগ্রিক গতিভঙ্গ। যথেষ্ট চাহিদা না থাকার কারণে যথেষ্ট উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটে না; তার ফলে শ্রমের চাহিদাও কম। এবং, শ্রমের চাহিদা কম হলে শ্রমের মূল্যও বাড়ে না অর্থশাস্ত্রের প্রাথমিক সূত্র অনুসারেই। প্রশ্ন হল, সেই সমস্যার কোনও সমাধানসূত্র কি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে আছে? না কি, তাঁদের ‘এখনও চাকরিটুকু আছে’, এই ভরসাই এই শ্রেণির মানুষদের একমাত্র সম্বল?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)