স ংঘাত আক্রমণ ধ্বংসলীলার দুই পাশে মানুষ আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যায়— তবু তাদের এক সুরে বেঁধে রাখে দুর্দশা আর যন্ত্রণা। মণিপুরে যে ঐতিহাসিক জাতিদাঙ্গা দেখা গেল, তার পরিণামে এক দিকে মেইতেই, অন্য দিকে কুকি-জ়ো জনজাতির পরিস্থিতিও সেই রকম, পরস্পরের প্রতি খড়্গহস্ত কিন্তু নিজ নিজ জীবনে একই রকম অসহনীয় বাস্তবের শিকার। ৩ মে মণিপুর হিংসার দুই বছর পূর্ণ হওয়ার দিন ছিল। দুই বছর পরও ধ্বংসের চিহ্নে ছেয়ে আছে দরিদ্র পার্বত্য রাজ্যটি, এখনও দোকানপাট বাড়িঘর ভাঙাচোরা কিংবা আগুনে পোড়া, রাস্তা শুনশান, স্কুলকলেজ ফাঁকা, গণপরিবহণের দেখা নেই, ওষুধপত্রের খোঁজ নেই। সরকারি অফিসকাছারিতেও মানুষের দেখা মেলে স্বল্প সময়েই। রাজ্যটি যে চলছে কী করে, এই এক অপার বিস্ময়। আর রাজ্যবাসীর জীবন— তা থেমে থাকার নয় বলেই চলছে, নয়তো দাঁড়িয়ে পড়ত, বিপদে অবসাদে আশঙ্কা আর আতঙ্কে।
এই বিপুল ব্যাপ্ত মানবিক সঙ্কটের দায় স্পষ্টতই— কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের। সেখানে গোষ্ঠী সংঘর্ষ কেন বেধেছিল, এত দিনে অনেকেরই তা জানা, সেই সংরক্ষণকেন্দ্রিক প্রশাসনিক পদক্ষেপের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের অপরিণামদর্শিতা ছিল অক্ষমণীয়। অবশ্যই সংঘর্ষ যে এমন ভয়াল পর্য়ায়ে পৌঁছবে, তা কারও জানা ছিল না। কিন্তু এত দিন ধরে এমন হিংসার বিস্ফোরণ যে চলতে পারল, এত মানুষ আক্রান্ত ধর্ষিত গৃহহারা সর্বহারা হলেন, তার দায় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে নিতেই হবে। হিংসা বন্ধ করতে না পারা— সর্বতোভাবেই তা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ব্যর্থতা, আর কাউকে দোষ দেওয়া যেতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী মোদী এখনও অবধি এক বারও পা রাখেননি সেখানে, যদিও যে কোনও রাজ্যে নির্বাচন এলেই দেখা যায় ক্ষণে ক্ষণেই তিনি সেখানে ছুটছেন। তাঁর এই ভয়াবহ দায়িত্বস্খলনের জন্য তাঁকে অভিযোগের কাঠগড়ায় তোলার কেউ নেই, বিরোধীরা নখদন্তহীন। মণিপুরে গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহের সরকারকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়েছে, কিন্তু এখনও পরিস্থিতি তথৈবচ। প্রথমে যে আশার আলো ফুটেছিল স্থানীয় মানুষের মনে, তিন মাস পরে তা সম্পূর্ণ অন্তর্হিত। কোনও একটি স্থায়ী সমাধানে আসার জন্য সকলকে এক সঙ্গে বসতে হবে, অথচ এখনও সেটুকু সম্ভব করে উঠতে পারেনি বিজেপি শাসক। মেইতেইদের অভিযোগ মায়ানমার থেকে চিন-কুকি সন্ত্রাসীরা এসে ভয়ঙ্কর কার্যকলাপ করে চলেছে। ‘বহিরাগত’দের আগে না থামালে কোনও কথোপকথনেই তারা রাজি নয়। উল্টো দিকে কুকিদের দাবি একটিই: স্বশাসন।
আশঙ্কা, দীর্ঘ সময় ধরে অচলাবস্থা চললে আবারও নতুন রক্তপাত-হিংসার প্লাবন শুরু হতে পারে। এমনিতেই যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে বেড়ে চলেছে জঙ্গি প্রভাব। সাম্প্রতিক কাশ্মীর সন্ত্রাসঘটনার পর কেন্দ্রীয় সরকারের বোঝা উচিত, উঁচু গলায় স্বাভাবিকতা ফেরার দাবি তুললেই তা সত্যি হয়ে যায় না। ভিতরে ভিতরে রক্তক্ষরণ চলতেই থাকে, কখন যে তা আকস্মিক বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে জানার উপায় থাকে না। মণিপুরকে এখন তেমনই একটি অনন্ত রক্তক্ষরণের স্থান করে রেখে দেওয়া হয়েছে— যদিও ভারতের মূলভূমির রাজনীতি তা বিস্মৃত হয়ে থাকে। ঘন সিঁদুরে মেঘ থেকে কিছু শিক্ষা নেওয়া উচিত, এটাই লোকপ্রজ্ঞা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)