E-Paper

প্রতিরোধহীন

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে লাগাতার ইজ়রায়েলি আক্রমণে গাজ়ায় বর্তমানে যে বিপুল মাপের অসহনীয় মানবাধিকার সঙ্কট তৈরি হয়েছে— তাতে কেবল ভারত কেন, বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ দৃশ্যমান।

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৫৩

ধন্য সেই ‘গণতন্ত্র’ যেখানে প্রতিবাদ আন্দোলন করতে গেলে নিদান আসে, নাগরিক কোন বিষয়ে মাথা ঘামাতে পারেন, আর কোন বিষয়ে পারেন না। শোনা যায়, রাজনৈতিক দলগুলি কোন ঘটনাকে গুরুত্ব দিতে পারে, কোন ঘটনাকে পারে না। গত সপ্তাহে মহারাষ্ট্রে তেমনই একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হল। গাজ়ার মানবসৃষ্ট তীব্র সঙ্কট নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট) প্রতিরোধ আন্দোলনে অবতীর্ণ হলে তা নিয়ে মামলা হয়, এবং তা আদালতে পৌঁছনোর পর হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ থেকে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বার্তা আসে— দেশের মধ্যেকার এত সমস্যা থাকতে তাঁরা কোন কারণে খামোকা বিদেশের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন! বিচারপতিরা বলেন, প্রতিবাদীদের দৃষ্টি সঙ্কীর্ণ, এবং তাঁরা যথেষ্ট দেশপ্রেমী নন। না বলে উপায় নেই যে এই সুতীব্র ভর্ৎসনা এক বিরাট অংশের মুক্তবুদ্ধির দেশবাসীকে অবাক করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কে কী নিয়ে ভাবতে পারেন বা পারেন না— সে কথা কেউ কাউকে নির্দেশ দিতে পারেন না, তা সোজাসুজি গণতান্ত্রিক ভারতের নাগরিকের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। আর আদালতের চত্বর থেকে এই বাণী কী ভাবে ভেসে এল, তা ভাবলে বিপন্ন বোধ করতে হয়। ভারতের মতো একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ও গুরুত্বপূর্ণ গণতন্ত্রের এই হাল কিছু দিন আগেও ভাবনাতীত ছিল। অবশ্য গত এক দশকে ভারত অতি দ্রুত এমন একটি অবতলে এসে দাঁড়িয়েছে, যাতে ‘ভাবনা’র অক্ষ-দ্রাঘিমাও পুরোদস্তুর পাল্টেছে। বাস্তবিক, এও লক্ষণীয় যে এমন সংবাদ আজ সর্বভারতীয় জনমানসে এসে পৌঁছনোর পর ক্ষীণ তরঙ্গ তুলেই কেমন বিস্তীর্ণ মহাকালে বিলীন হয়ে যায়। সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যম জুড়ে কেবল ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে চলে নাগরিক অধিকারের সীমা দর্শানোর তর্জনীশাসন, কাকে বলে দেশপ্রেম সেই মর্মে অন্ধতা ও সঙ্কীর্ণতার পাখিপড়া অনুশীলন। ‘যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা’: জীবনানন্দের সেই অলঙ্কারশাণিত পঙ্‌ক্তিই প্রত্যহ আরও বেশি করে নিরলঙ্কার সত্য হয়ে উঠেছে।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে লাগাতার ইজ়রায়েলি আক্রমণে গাজ়ায় বর্তমানে যে বিপুল মাপের অসহনীয় মানবাধিকার সঙ্কট তৈরি হয়েছে— তাতে কেবল ভারত কেন, বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ দৃশ্যমান। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নানা দেশের সাধারণ মানুষ— বিশেষত ছাত্রছাত্রীরা— প্রতিবাদে মুখর। এঁরা সবাই বিপ্লবী বা বামপন্থী নন, এমনকি তাঁরা নিজেদের রাষ্ট্রের বিরোধিতা করার সুযোগ বা অভিসন্ধিও খুঁজছেন না। এমনকি কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক না হয়েও তাঁরা শুধু মানবাধিকার ও মানবকল্যাণে বিশ্বাস করেই পথে নেমে এসেছেন। সম্প্রতি তেল আভিভেও রাষ্ট্রের নীতির বিরুদ্ধতায় পথে নেমেছেন শুভবোধসম্পন্ন ইজ়রায়েলিরা। বিলম্বে হলেও এই বিশ্বজোড়া প্রতিরোধ মানবিকতার বিশ্বাস ফিরিয়ে আনে।

তবে গাজ়ার বাস্তব স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে, বিশ শতকের জার্মানির থেকে একুশ শতকের প্যালেস্টাইন বেশি পিছিয়ে নেই। জেনোসাইডের ঘোষিত লক্ষ্য নিয়েই এগোচ্ছে ইজ়রায়েল। অনাহারে সেখানকার শিশুরা প্রতি দিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, অথচ সে হিসাব যুদ্ধনিহতের সরকারি তালিকায় যোগ হচ্ছে না। এত দিন ত্রাণসাহায্য বন্ধ ছিল, ত্রাণবাহকরাও নিরাপদ ছিলেন না, এখন আকাশপথে ত্রাণ বিতরণ শুরু হতে বিমানের অপেক্ষায় ঊর্ধ্বমুখে দুর্বল জীর্ণ মৃতপ্রায় নারীপুরুষ। একবিংশ শতকের বিশ্ব এমন পরিকল্পিত গণহত্যার দৃশ্য আর দেখেনি বললে ভুল হবে না। আরও অভাবনীয়, এই হত্যাকাণ্ড সংঘটনকারীদের সহায়ক হল পশ্চিম বিশ্বের তাবৎ উন্নত ধনী ও বলশালী দেশ। সভ্যতার এই চরম সঙ্কটে ভারতের মতো দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে সমাধান বা সমস্যা নিরসনের প্রয়াস করা অত্যন্ত দুরূহ। অন্তত উদ্বেগনিষিক্ত প্রতিবাদ-প্রতিরোধের অধিকারটি হরণ করা না হোক!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bombay High Court CPIM

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy