ভারতীয় সংস্কৃতি যুগ-যুগান্ত ধরে শিক্ষককে ‘আচার্য’ রূপে চিনেছে। তিনি শুধু জ্ঞান দান করেন না, আপন আচরণের মাধ্যমে ছাত্রদের নৈতিক ভাবে জীবনযাপনের পথটি দেখান। এই কারণে তিনি পরম শ্রদ্ধেয়। কিন্তু, রাজ্যের বিভিন্ন কোণে যে সকল ঘটনা নিয়ত ঘটে চলেছে, তা শিক্ষকসমাজের প্রতি ছাত্রদের শ্রদ্ধা, সমীহ ও সম্ভ্রমকে ক্রমশ মুছে দিচ্ছে। উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের এক স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পদপ্রাপ্তির বিরোধিতা করে দায়ের হওয়া মামলায় এই তিক্ত প্রসঙ্গ উঠল আবারও। বিচারপতিকে স্মরণ করাতে হল, শিক্ষকতা এক মহৎ পেশা। আদর্শ শিক্ষক ছাত্রদের চরিত্রগঠনেও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন। উল্লেখ্য, এ ক্ষেত্রে পদের আশায় মামলাকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধেই ফৌজদারি অপরাধ ছাড়াও ছাত্রীদের প্রতি আপত্তিকর আচরণের অভিযোগ ছিল।
সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে রাজ্যের সব শিক্ষকের মাপকাঠি হিসাবে দেখার প্রয়োজন নেই। কিন্তু, এ কথা অনস্বীকার্য যে, শিক্ষাক্ষেত্রে যত অন্যায়ের অন্ধকার ঘনিয়েছে, ততই কালিমালিপ্ত হয়েছে শিক্ষকের ভাবমূর্তি। তাঁদের অতি-সাধারণ আচরণই তাঁদের অ-সাধারণত্বের আসন থেকে নামিয়ে এনেছে। বিদ্যার মহিমায় যে গুরুর সর্বত্র পূজিত হওয়ার কথা, এখন তাঁদের পরিচয়ের বাহক যোগ্য ও অযোগ্য শিক্ষকের তকমা। তবে, এই পতন শুধু গত দেড় দশকেরই নয়। পূর্বতন জমানা থেকেই রাজ্যে শিক্ষকতার যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক আনুগত্য। শিক্ষায়তন ও ছাত্রদের প্রতি অবহেলা ঢেকে যেতে শুরু করে দলীয় সংগঠনের প্রতি মনোযোগে। ক্লাসের পড়াকে উপেক্ষা করে টিউশন-রাজ শুরু হয়, মানুষ গড়ার বদলে বহু শিক্ষক হয়ে ওঠেন প্রশ্ন ফাঁসের কারিগর, দুর্নীতি ও স্থানীয় নেতার সঙ্গে সুসম্পর্কই তাঁর ক্ষমতার চোখধাঁধানো অলঙ্কার। সেই পচনশীল ব্যবস্থাই ফেটে পড়ে দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে সাম্প্রতিক নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে। সব শিক্ষকেরই যে এ রকম পতন ঘটেছে, তেমন দাবি করার প্রশ্নই নেই— কিন্তু বাস্তব বলছে, যত শিক্ষকের ঘটেছে, সে সংখ্যাটিও নগণ্য নয়। সমাজের পক্ষে তা এক মারাত্মক ঘটনা। ‘শিক্ষক’ বলতেই এখন আর কোনও শ্রদ্ধেয় ছবি মনে আসে না, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী?
শিক্ষকের ভূমিকা কেবল শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ নয়। তাঁদের নৈতিক আচরণ সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করে। ছাত্রদের কাছে তাঁরা আদর্শস্বরূপ, ছাত্ররা তাঁদের দেখেই শেখে, তাঁদের থেকেই অনুপ্রাণিত হয়। প্রশ্ন হল, ইতিবাচক, না কি নেতিবাচক, কেমন আদর্শ তাঁরা স্থাপন করবেন? কেউ বলতে পারেন, শিক্ষকরাও এই সময়েরই ফসল, এই গলিত-স্খলিত সমাজেরই সন্তান। সেখানে দুর্নীতি আর অন্যায় সর্বব্যাপী হলে শিক্ষকরাই বা তার বাইরে থাকেন কী ভাবে? কথাটি ভুল নয়, কিন্তু সমাজের পচন থেকে নিজেদের রক্ষা করা, ছাত্রদের সামনে নিজেদের অমলিন চেহারাটি হাজির করানোর নৈতিক দায়িত্বও এক জন শিক্ষক কোনও ভাবে অস্বীকার করতে পারেন না। প্রতিটি কাজ করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করা তাঁর কর্তব্য যে, সেই কাজটি কি ছাত্রদের কাছে কোনও ইতিবাচক বার্তা বহন করে? এই কথাগুলি শিক্ষকদের উদ্দেশ করে বলতে হচ্ছে, সেটাই যথেষ্ট লজ্জার। তাঁরাই যে মানুষ গড়ার কারিগর, এ কথা তাঁরা ভুললে চলবে কেমন করে?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)