E-Paper

ভুলের দায়িত্ব

২০১৮ সালে কলকাতা হাই কোর্ট এসএসসি-কে নির্দেশ দেয় ন’জন চাকরিপ্রার্থীর প্রত্যেককে এক নম্বর অতিরিক্ত দেওয়ার জন্য। অভিযোগ ছিল, ঐতিহাসিক গান্ধী-আরউইন চুক্তির তারিখটি তাঁরা ঠিক লেখা সত্ত্বেও ‘ভুল’ বলে নম্বর-বঞ্চিত হয়েছেন।

শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৩৬

যা চিরকালীন, চিরসত্য— ব্যাকরণের নিয়মেও তা ‘কাল-জয়ী’। সেই নিয়মেই সূর্যের পূর্ব দিকে ওঠাকে অতীতকালে ঠেলে দেওয়া চলে না। নিজ দেশের প্রতি নাগরিকের ভালবাসারও স্মৃতিচারণ হয় না। পশ্চিমবঙ্গে স্কুল সার্ভিস কমিশন-এর নিয়ম অবশ্য আলাদা। সেখানে দুর্নীতির পরিধিটিও যেমন স্তম্ভিত করে দেয়, সদ্যসমাপ্ত এসএসসি-র একাদশ-দ্বাদশের পরীক্ষার মডেল উত্তরপত্রটির ভুলের বহর দেখেও চমকিত হতে হয়। এক-দু’ক্ষেত্রে নয়, একাধিক বিষয়েই এমন ভুল। এসএসসি অবশ্য পরীক্ষার্থীদের উত্তর চ্যালেঞ্জ করার রাস্তাটি খোলা রেখেছে। মডেল উত্তরপত্রের ‘ভুল’টি বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্রমাণিত হলে আবেদনের ১০০ টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাসটিও দিয়ে রেখেছে। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগের মতো এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় অতি সাধারণ ভুল-সর্বস্ব মডেল উত্তরপত্র প্রকাশ করা হবে কেন, সেই উত্তর মেলেনি। কোনও উত্তর বিষয়ে পরীক্ষার্থীর সংশয় থাকলে সেই ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে প্রমাণ-সহ উত্তরকে চ্যালেঞ্জ জানানো যুক্তিযুক্ত। কিন্তু যে ভুল দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, যা সচরাচর বিদ্যালয়ের নিচু ক্লাসেই শুধরে দেওয়া হয়ে থাকে, সেই উত্তরকে ১০০ টাকা খরচ করে চ্যালেঞ্জ জানানোর হয়রানি পরীক্ষার্থীরা ভোগ করবেন কেন, তাও বোধাতীত।

সর্বাপেক্ষা উদ্বেগজনক, এই ভুলের ফাঁদে পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্রের যথাযথ মূল্যায়নও আটকে পড়তে পারে। স্কুল সার্ভিস কমিশন-এর মতো একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এক-আধ নম্বরের তারতম্যও পরের ধাপটিতে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে বিরাট তফাত গড়ে দেয়। সে ক্ষেত্রে আশঙ্কা প্রবল যে, সঠিক উত্তর দিয়েও ‘ভুল’ প্রমাণিত হওয়ায় যোগ্য প্রার্থীরা চাকরির পাওয়ার লড়াই থেকে ছিটকে যাবেন। ঠিক এই কারণে এত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, এবং মডেল উত্তরপত্র প্রস্তুতির সময় কোনও ফাঁক রাখা চলে না। একাধিক বিশেষজ্ঞকে দিয়ে যাচাই করে তা নিখুঁত করে নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষত সেই পরীক্ষার ক্ষেত্রে, ইতিমধ্যে যেখানে অপরিসীম দুর্নীতির দায়ে প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী চাকরিহারা হয়েছেন। এই পরীক্ষা যোগ্য চাকরিহারাদের কাছে আক্ষরিক অর্থেই জীবন-মরণের পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু উত্তরপত্রের বিচিত্র ভুল, এবং প্রশ্নপত্রে একাধিক বিতর্কিত প্রশ্নকে জায়গা দেওয়া প্রমাণ করে দেয়, এসএসসি এই বছরও পরীক্ষাগ্রহণের প্রস্তুতিটি নিশ্ছিদ্র করতে পারেনি। বরং পরোক্ষে তারা পরীক্ষার্থীদের উপরেই দায়িত্ব চাপিয়েছে, যাতে তারা এই শিশুসুলভ ভুলগুলিকে ‘ভুল’ প্রমাণ করার ঝক্কিটি বহন করে।

এ-হেন ভুল এসএসসি-র এই বছরই প্রথম নয়। ২০১৮ সালে কলকাতা হাই কোর্ট এসএসসি-কে নির্দেশ দেয় ন’জন চাকরিপ্রার্থীর প্রত্যেককে এক নম্বর অতিরিক্ত দেওয়ার জন্য। অভিযোগ ছিল, ঐতিহাসিক গান্ধী-আরউইন চুক্তির তারিখটি তাঁরা ঠিক লেখা সত্ত্বেও ‘ভুল’ বলে নম্বর-বঞ্চিত হয়েছেন। একটি রাজ্যের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার জরাজীর্ণ ছবিটি আরও স্পষ্ট হয় এতে। শিক্ষক থেকে ছাত্র— পরীক্ষা নিয়ামকের ভুল থেকে কেউ রেহাই পান না। চাকরিহারারা যোগ্য না অযোগ্য— সে নিয়ে দীর্ঘ সামাজিক চর্চা চলে। শিক্ষাপ্রশাসনে যে অসংখ্য অযোগ্য দীর্ঘ দিন ধরে ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছেন, শিক্ষক পদপ্রার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে চলেছেন, তাঁদের শাস্তির ভার কে নেবেন?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

SSC WBSSC

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy