রাজ্য সরকারের ২০২৫-২৬ সালের বাজেট-বক্তৃতায় ‘স্কুল শিক্ষা’ নামাঙ্কিত অংশে সাতটি অনুচ্ছেদ আছে। উচ্চশিক্ষা, প্রযুক্তি শিক্ষা ইত্যাদির কথাও অন্য নানা অংশে এসেছে, তবে আপাতত স্কুলেই মনোনিবেশ করা যেতে পারে। প্রথমত, সেখানেই শিক্ষার ভিত তৈরি হয়। দ্বিতীয়ত, উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ভূমিকা অনেকখানি, কিন্তু স্কুলশিক্ষার পরিসরে সরকার বলতে পনেরো আনাই রাজ্য সরকার, কেন্দ্র সেখানে কার্যত প্রান্তিক। উপরোক্ত সাতটি অনুচ্ছেদে পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী নানা খবর জানিয়েছেন। বর্তমান সরকারের আমলে স্কুলের পরিকাঠামো এবং সাজসরঞ্জামের সরবরাহে উন্নতির খবর। যেমন, স্কুলবাড়ি, শৌচাগার, পাঠ্যবই, মিড-ডে মিল, স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট, ইত্যাদি। ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় ট্যাবলেটের উপযোগিতা কতটুকু পাওয়া গেল, সেই প্রশ্ন সরিয়ে রেখে সামগ্রিক ভাবে অবশ্যই বলা যেতে পারে যে, শিক্ষার প্রকরণ বা সহায় হিসাবে এই বিষয়গুলি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু বাজেট-ভাষণে স্কুলশিক্ষা বলতে শুধু এগুলিকেই বোঝানো হবে কেন? কেনই বা দীর্ঘ একটি অনুচ্ছেদ জুড়ে লেখা হবে এই আশ্চর্য সুসংবাদ যে ছাত্রছাত্রীদের মার্কশিট এবং অন্য নানা নথিপত্র ডিজিটাল পরিসরে নিরাপদে রাখার কাজ বহু দূর অগ্রসর হয়েছে? খুবই ভাল কাজ হয়েছে, সন্দেহ নেই, কিন্তু এ-সবই তো পাদটীকার বিষয়, শিক্ষার মূল প্রশ্নে জোর না দিয়ে প্রায় গোটা আলোচনাই এই বিষয়গুলিতে সীমিত রাখা হল কেন?
প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও অজানা নয়। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের কাছে শিক্ষার মূল প্রশ্নটি গৌণ, বস্তুত তুচ্ছ। ছাত্রছাত্রীরা যথাযথ ভাবে লেখাপড়া করতে পারছে কি না, তা নিয়ে তাঁদের কিছুমাত্র মাথাব্যথার লক্ষণ দেখা যায় না। শিক্ষার প্রতি এই ঔদাসীন্যের সবচেয়ে বড় প্রমাণ মিলেছিল অতিমারির দিনগুলিতে, যখন গৃহবন্দি শিশু-কিশোরদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করার কোনও কার্যকর উদ্যোগ তাঁরা করেননি, উপরন্তু স্কুলশিক্ষকরা নিজস্ব উদ্যোগে তেমন কোনও সাহায্য করতে চাইলে শাসক শিবিরের স্থানীয় মাতব্বররা সেই চেষ্টায় বাধা দিয়েছিলেন, এমন অভিযোগও বিস্তর শোনা গিয়েছে। কেবল অতিমারির সময়ে নয়, সাধারণ ভাবেই এ রাজ্যের সরকারি কর্মকাণ্ডে শিক্ষার প্রতি কিছুমাত্র মনোযোগ নেই, নেই বলেই প্রতি বছর সম্পূর্ণ অকারণে স্কুল ছুটি করে দেওয়া হয়, তুঘলকি চালে শিক্ষকদের পছন্দসই স্কুলে বদলি নেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে গ্রামাঞ্চলে দূরবর্তী তথা প্রান্তিক এলাকার স্কুলগুলিকে শিক্ষকশূন্য করে দেওয়া হয়, এবং শিক্ষা সংক্রান্ত যে কোনও বিষয়ে প্রশ্ন তুললে ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে ‘লোকে বলে করি আমি’ জপ করেন।
এ-হেন সরকারের অর্থমন্ত্রী বাজেট-ভাষণে মার্কশিট ‘আপলোড’ করা এবং ‘ট্যাবলেট’ বিতরণের মহিমা কীর্তনেই সীমিত থাকবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? না, স্কুলশিক্ষা বিষয়ক আলোচনার শেষ অনুচ্ছেদে তিনি সাফল্যের শংসাপত্রও দাখিল করে জানিয়েছেন: কেন্দ্রীয় সরকারের একটি রিপোর্টে বনিয়াদি সাক্ষরতা এবং সংখ্যাজ্ঞানের মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গ দেশের বড় রাজ্যগুলির মধ্যে প্রথম হয়েছে! এই ধরনের সমীক্ষা কতটা নির্ভরযোগ্য, সেই প্রশ্ন বহুচর্চিত, বিশেষত তার তথ্য-পরিসংখ্যানের বড় অংশ যখন রাজ্য সরকারই সরবরাহ করে থাকে! পাশাপাশি, এএসইআর রিপোর্টের মতো সুপরিচিত সমীক্ষায় যখন ক্রমাগত এই উদ্বেগজনক সংবাদই পাওয়া যাচ্ছে যে, ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশ প্রাথমিক শিক্ষার বনিয়াদি সামর্থ্যটুকুও অর্জন করছে না। এই বাস্তবের সামনে দাঁড়িয়ে রাজ্য সরকার ছেঁদো কথার চর্বিত চর্বণ ছেড়ে শিক্ষার হাল ফেরাতে সর্বাত্মক উদ্যোগ শুরু করবে? রাম রাম! সুতরাং বাজেট-ভাষণে ট্যাবলেটের জয়গান করে অর্থমন্ত্রী শিক্ষা খাতে যৎসামান্য বরাদ্দ বাড়িয়েছেন, অর্থাৎ— বড় জোর— স্থিতাবস্থা বজায় রেখেছেন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)