রাজনীতির ময়দানে প্রতিশ্রুতি আর ক্রিকেটের ময়দানে রেকর্ড— দুই-ই নাকি করা হয় স্রেফ ভাঙার জন্য। যে রসিক এই ঠাট্টার আবিষ্কর্তা, তিনিও এ সপ্তাহে উইয়ান মুল্ডারের ‘কীর্তি’ দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হতেন নিশ্চয়ই। জ়িম্বাবোয়ে সফররত দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলের এই অধিনায়ক-ব্যাটার দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় দিনে শুধু ব্যক্তিগত তিনশো রানের গণ্ডিই ছাড়ালেন না, টেস্ট ক্রিকেটের দীর্ঘ ইতিহাসে এক ইনিংসে যা সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর, ব্রায়ান লারার সেই অবিস্মরণীয় ‘৪০০ নট আউট’ ছোঁয়া ও ভাঙার দোরগোড়ায় পৌঁছেও ব্যক্তিগত ৩৬৭ নট আউট স্কোরে ইনিংস ডিক্লেয়ার করলেন। কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন, ব্রায়ান লারার মতো এক ক্রিকেটারের প্রতি শ্রদ্ধাতেই তিনি তাঁর রেকর্ড ভাঙতে চাননি। এমনকি আবারও এমন সুযোগ পেলে তিনি ঠিক এই কাজই করবেন, লারার রেকর্ড ভাঙবেন না।
মুল্ডারের এই কাজে ও কথায় বিশ্ব ক্রিকেট আপ্লুত, বিস্মিত। টেস্ট ক্রিকেটে একটি শতরান প্রাপ্তিও যেখানে বিরাট দক্ষতা ও ধৈর্যের ফসল, সেখানে ‘চারশো নট আউট’-এর মতো রেকর্ড ছোঁয়া ও তা ভাঙার সুযোগ বাস্তব পরিস্থিতিতে অতিবিরল, হয়তো বাকি ক্রিকেটজীবনে না-ও আসতে পারে— মুল্ডার ভাল ভাবেই জানেন। তথাপি ব্রায়ান লারার মতো ক্রিকেটারের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা এবং নিজের সংযম ও নিয়ন্ত্রণের প্রশংসা করতেই হয়। প্রতিযোগিতাসর্বস্ব এই ক্রিকেট-যুগে যেখানে নবপ্রজন্ম মুখিয়ে থাকছে ক্রিকেটের বরেণ্য নায়কদের পাশে বা তাঁদেরও ছাড়িয়ে নিজের নাম ইতিহাসে খোদাই করতে, সেখানে মুল্ডারের এই সুযোগ পেয়েও না নেওয়াটা ব্যতিক্রমী।
আবার তা তর্কযোগ্যও। মুল্ডারের দৃষ্টিভঙ্গি যে নিঃস্বার্থ তা নিয়ে সংশয় নেই। লারার রেকর্ড অক্ষত রেখেও তিনি নিজে একাধিক রেকর্ড গড়েছেন: অধিনায়ক হিসাবে প্রথম টেস্ট ম্যাচে এক ইনিংসে সর্বাধিক রানের রেকর্ড, এবং আরও কয়েকটি। এই সূত্র ধরেই বলা যায়, তাঁর ব্রায়ান লারার রেকর্ড ভাঙতে না চাওয়ার যুক্তিটি সৎ হলেও অকাট্য নয়। রেকর্ড চিরস্থায়ী নয়, বরং এ কালের ক্রিকেটে তার ভাঙা ও গড়া দুই-ই হয়ে চলেছে দ্রুত ও নিয়মিত, মুল্ডার লারার রেকর্ড ভাঙেননি বলেই অচিরে আর কোনও প্রতিভাবান ব্যাটার যে তা ভাঙবেন না বা ভাঙতে চাইবেন না, বলা যায় না। যদি কেউ ভাঙেনও, সেই কাজকেও শতমুখে প্রশংসাই করতে হবে, এতকালের রেকর্ডটি ভেঙে গেল বলে এই বিরাট কীর্তির স্রষ্টাকে ছোট করা চলে না। এও মনে রাখার, চারশো রান করে রেকর্ড গড়ার পথে ব্রায়ান লারাও নিশ্চিত ভাবেই তাঁর সময়ের ও আগের একাধিক স্মরণীয়-বরণীয় ক্রিকেটারের রেকর্ড ভেঙেছিলেন। অর্থাৎ, খেলার স্বাভাবিক নিয়মই এই, একের রেকর্ড অন্যে ভাঙবে, আজ নাহয় কাল— এই দুইয়ের মাঝে যতটুকু সময় তা অক্ষত থাকে তাতে রেকর্ডধারীর প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান তুঙ্গ স্পর্শ করতে পারে, কিন্তু সেই রেকর্ড অন্য কেউ ভেঙে দিলে আগের মানুষটির শ্রদ্ধার আসন টলে যায় না। অনেকে বলছেন যে লারার রেকর্ডটি ছিল শক্তিশালী ইংল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে, তুলনায় দুর্বল দল জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে চারশো করলে তা তত জাতে উঠত না। মুল্ডার তা ভাবেননি নিশ্চয়ই, কোনও প্রকৃত খেলোয়াড়ই ভাববেন না— তথাপি রেকর্ড না ভাঙার পক্ষ-বিপক্ষ দু’দিকেই যুক্তির পাল্লা সমান ভারী।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)