নীতি আয়োগের কর্তা বি ভি আর সুব্রহ্মণ্যম নাহয় খানিক আগেই কৃতিত্ব দাবি করেছেন— কিন্তু, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা আয়তনে জাপানকে টপকে যেতে চলেছে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের হিসাব অনুসারে, ঘটনাটি বর্তমান অর্থবর্ষ শেষ হওয়ার আগেই ঘটবে। যদি কোনও কারণে আর ক’টা দিন বেশি সময় লাগেও, ভারতের বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা হয়ে ওঠা আক্ষরিক অর্থেই কিছু সময়ের অপেক্ষা। এমনকি, জার্মানিকে টপকে তৃতীয় বৃহত্তম হয়ে উঠতেও খুব বেশি বছর সময় না লাগারই কথা। কিন্তু, তাতে কী? প্রধানমন্ত্রীর ভক্তরা এই কৃতিত্বের সম্পূর্ণাংশই তাঁকে নিবেদন করতে উদ্গ্রীব— কিন্তু, কাণ্ডজ্ঞান এবং পরিসংখ্যান, কোনওটাই সে কথা বলছে না। পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, ভারতের এই উত্থানের গতিপথটি গত সাড়ে তিন দশক ধরে রচিত হয়েছে। গত দশ বছরে একাধিক বার সেই গতি বরং ধাক্কা খেয়েছে— কখনও অভ্যন্তরীণ কারণে, কখনও বা বৈশ্বিক অতিমারির জন্য। অবশ্য, পরিসংখ্যানের জটিলতায় না ঢুকেও কথাটি বোঝা চলে— বিশ্বের জনবহুলতম দেশ, নেহাত তার জনসংখ্যার কারণেই, বিপুলায়তন অর্থব্যবস্থার অধিকারী হবে, তাতে বিস্ময়ের কোনও কারণ আছে কি? দু’জনের পরিবারে মাসে ৫০,০০০ টাকা উপার্জন, আর দশ জনের পরিবারে মাসে ৬০,০০০ টাকা— কোন পরিবারটি আর্থিক ভাবে ভাল অবস্থায় আছে, তা বোঝার জন্য অর্থশাস্ত্রী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। সেই কাণ্ডজ্ঞান বলে, জিডিপি-র অঙ্ক নিয়ে এত উচ্ছ্বাসের কোনও কারণ নেই।
জাপানের সঙ্গে তুলনা করলেই কথাটি স্পষ্ট হবে। সে দেশের জনসংখ্যা সাড়ে বারো কোটির কিছু কম, এবং মাথাপিছু জিডিপি ৩৩,৯৬০ ডলার। ভারতে মাথাপিছু জিডিপির অঙ্কটি ২৮৮০ ডলার। অর্থাৎ, যে দেশটিকে জিডিপির মাপে ভারত টপকে গেল বলে, তার মাথাপিছু জিডিপি ভারতের প্রায় বারো গুণ। ফলে, পরিকাঠামো থেকে মানব উন্নয়ন, কোনওটিতেই জাপানের সঙ্গে ভারতের আদৌ তুলনা চলে না। আজও নয়, জিডিপির মাপে টপকে যাওয়ার পরেও নয়— অন্তত, অদূর ভবিষ্যতে নয়। চিনের অর্থব্যবস্থা যখন ভারতীয় অর্থব্যবস্থার আজকের মাপে, অর্থাৎ চার লক্ষ কোটি ডলার আয়তনে, ছিল, সেই ২০০৮ সালে সে দেশে মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৩৫০০ ডলারের কাছাকাছি। এখন চিনের মাথাপিছু জিডিপি ১৩,০০০ ডলারের বেশি, অর্থাৎ চিন দাঁড়িয়ে রয়েছে উন্নত দেশ হিসাবে গণ্য হওয়ার দোরগোড়ায়। এই দূরত্ব চিন অতিক্রম করেছে দেড় দশকে। হিসাব বলছে, এই গতিতে চললে উন্নত দেশ হয়ে উঠতে, অর্থাৎ মাথাপিছু জিডিপি ১৪,০০৫ ডলারের বেশি হতে সময় লাগতে পারে আরও তিন দশক। জাপানের আজকের মাথাপিছু জিডিপির স্তরে পৌঁছতে কত সময় লাগবে, সে হিসাব কষা বাহুল্যমাত্র।
ভারতে বর্তমানে যে হারে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটছে, আগামী তিন দশক ধারাবাহিক ভাবে সেই হার বজায় রাখা দুরূহ কাজ। যদি ধরা যায় যে, কোনও মন্ত্রবলে ভারত তাতে সক্ষম হল, তাতেই বা কী? মাথাপিছু জিডিপি বাড়া মানেই কিন্তু প্রত্যেকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি নয়— ওটা গড় হিসাবমাত্র। ধারাবাহিক আর্থিক বৃদ্ধির সুফল সবার কাছে পৌঁছবে কি না, তা নির্ভর করবে বণ্টনের সুষমতার উপরে, দেশের আর্থিক বৈষম্যের মাত্রার উপরে। বৈষম্য-গবেষক টমাস পিকেটির হিসাব অনুসারে, ভারতে বর্তমান আর্থিক বৈষম্যের মাত্রা ঔপনিবেশিক আমলের সঙ্গে তুলনীয়। গত এক দশকে কার্যত এমন কোনও নীতি রচিত হয়নি, যা সেই বৈষম্য কমানোর পক্ষে সহায়ক হতে পারে— বরং, ট্রিকল ডাউন অর্থনীতির তত্ত্ব সেই বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলছে। এই অবস্থায়, জিডিপির মাপে ভারত বিশ্বে কত নম্বর স্থানে থাকল, সে হিসাবে সাধারণ ভারতবাসীর কী বা আসে যায়?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)