বাংলার ঘরে ঘরে আজ বিদ্যুৎ পৌঁছলেও, তার প্রতিফলন কিন্তু ঘটছে না কোষাগারে। বস্তুত, গত কয়েক বছর ধরে রাজ্যের সরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা ‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা’ (ডব্লিউবিএসইডিসিএল)-র উপরে ‘ঘরের চাপ’ই বেশি। কারণ বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রাখার ক্ষেত্রে জনসাধারণের তুলনায় বকেয়া বেশি বিভিন্ন সরকারি দফতরের। সেই সূত্রেই গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সরকারি অফিসে প্রিপেড স্মার্ট ইলেকট্রিক মিটার বসানোর উদ্যোগ করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কিন্তু তাতে মেটেনি সমস্যা। অভিযোগ, এক হাজার কোটি টাকার বেশি বিদ্যুতের টাকা বকেয়া রয়েছে নানা সরকারি দফতরের। সরকারি অফিসের সংযোগ সহজে কেটে দেওয়া যায় না বলেই বিল মেটানো হয় না বলে দাবি অনেকের। তাই গত নভেম্বর থেকে ‘আগে টাকা, পরে বিদ্যুৎ’ পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা, যাতে সায় মেলে রাজ্য সরকারেরও। বস্তুত বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির লোকসান কমাতে গোটা দেশেই স্মার্ট মিটার এবং প্রিপেড সংযোগ চালুর সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রক। মূল লক্ষ্য— বিদ্যুতের অপব্যবহার বন্ধ করা, এবং বিল না মেটানোর প্রবণতা রোধ করা। এ বার এই রাজ্যে প্রক্রিয়াটিকে আরও জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য করতে আরও কিছু বাড়তি উদ্যোগ করা হয়েছে ডব্লিউবিএসইডিসিএল-এর তরফে।
প্রিপেড স্মার্ট ইলেকট্রিক মিটার কাজ করে প্রিপেড মোবাইল সংযোগের মতোই। প্রিপেডে ভরা অর্থের পরিমাণ শেষ হয়ে গেলে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে রিচার্জের ন্যূনতম অঙ্ক ১০০ টাকা। কিন্তু রাজ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপ পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূলত প্রচলিত বিদ্যুৎ মিটার থেকে প্রিপ্রেড স্মার্ট মিটারে রূপান্তরের প্রক্রিয়াটিকে মসৃণ করতে। শুধু তা-ই নয়, কোম্পানি শনিবার, রবিবার, সরকারি ছুটির দিন, এমনকি অফিসের সময়ের বাইরে কোনও গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ব্যালান্স শূন্যের নীচে ৩০০ টাকায় পৌঁছে গেলেও। এই ৩০০ টাকার ঋণাত্মক ব্যালান্স অনুমোদন করার অর্থ হল, রিচার্জের অঙ্ক শূন্য হয়ে যাওয়ার পর যদি গ্রাহক রিচার্জ করতে সমস্যায় পড়েন, তবে ডব্লিউবিএসইডিসিএল তাকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেবে। তবে ওই ঋণের সীমা অতিক্রম করার পর অফিসের সময়ের মধ্যেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে পুনঃসংযোগের জন্য, গ্রাহককে ঋণাত্মক ব্যালান্সের পরিমাণ জমা দিতে হবে এবং কমপক্ষে ১০০ টাকা দিয়ে মিটার রিচার্জ করতে হবে।
সিদ্ধান্তগুলির তাৎপর্য শুধু বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থার মধ্যেই সীমিত নয়। বিভিন্ন পরিষেবার ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েই থাকে— তা সময়ের দাবি। কিন্তু, যে পরিষেবাগুলি সাধারণ মানুষের জীবনে গভীর ভাবে জড়িত, সেখানে পরিবর্তন ঘটানোর সময়ে মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথাও মাথায় রাখা একই রকম জরুরি। রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার সিদ্ধান্তগুলি সেই কাজ করেছে। এমনও নয় যে, এই সুবিধা অনন্ত কাল বজায় রাখতে হবে— পরে তা ক্রমে প্রত্যাহার করে নেওয়াও সম্ভব। কিন্তু, ট্রানজ়িশন বা পর্বান্তরের সময়ে প্রক্রিয়াটিকে মসৃণতর করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাগুলি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)