দুর্ভাগ্য, কৃষক আন্দোলনের অভিঘাতে এমএসপি বস্তুটি ক্রমশই রাজনৈতিক সংঘাতের বিষয় হয়ে উঠেছে। শাসক-বিরোধী তরজায় এবং রাজনীতির হিসাবে আটকে গিয়েছে সংস্কার। সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য সংবাদ, খরিফ মরসুমের চোদ্দোটি ফসলের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। চাল এবং গমে মূল্য বেড়েছে যৎসামান্য, বেশি বেড়েছে রাগি, জওয়ার, বাজরা, তিল, সয়াবিন, ভুট্টা প্রভৃতির এমএসপি। এই শস্যগুলির ফলন বাড়াতে সরকার নানা ভাবে উৎসাহ দিচ্ছে, এমএসপি-র বৃদ্ধি তার অন্যতম। কারণটি জানা— ভূগর্ভের জলস্তর-চিত্রের নিরিখে জল-পিপাসু ধান-গমের থেকে স্বল্প সেচের ফসলের প্রতি চাষিদের আগ্রহ বাড়ানো দরকার। বর্তমানে বাজরা জাতীয় ফসলের উৎপাদন দু’কোটি টনেরও কম। রয়েছে আমদানি কমানোর যুক্তিও— বিদেশি মুদ্রায় ডাল এবং তৈলবীজ কিনতে বার্ষিক খরচ হয় দেড় লক্ষ কোটি টাকা। পুষ্টির নিরিখেও শর্করাপ্রধান খাদ্যশস্যের চেয়ে ডাল, আনাজের জোগান বাড়ানো প্রয়োজন। সত্তরের দশকে সবুজ বিপ্লবের জেরে গম ও ধানের উৎপাদন বহু গুণ বেড়েছিল, কিন্তু কমে গিয়েছিল ফসল-বৈচিত্র। বর্তমানে ভারত দ্বিতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদক, চালের রফতানিতে ভারত শীর্ষে। রফতানির পরেও সরকারের গুদামে মজুত রয়েছে যে পরিমাণ চাল, তা প্রয়োজনের চারগুণ বেশি। অতএব সরকার ধানের দাম বাড়াতে চায় না। তাতে চাষিরা অখুশি। স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মেনে হিসাব করলে ধানের এমএসপি প্রতি কুইন্টালে তিন হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। সেখানে ২৩৬৯ টাকা ধার্য করেছে সরকার। কৃষক সংগঠনগুলি প্রতিবাদে মুখর।
বাজারে ফসলের দামে যে ঘাটতি থাকছে, সরকার তা পূরণ করবে— চাষির এই প্রত্যাশার পাশে রয়েছে এই বাস্তব যে, কৃষির বাজারের ভারসাম্যহীনতা অনেকটাই তৈরি করেছে সরকারি নীতি। গত বছর খরিফ মরসুমের ফসল কিনতে সরকার ব্যয় করেছিল পঁয়ষট্টি হাজার কোটি টাকা। সরকারি ক্রয়ের ৯০ শতাংশেরও বেশি কেবল দু’টি ফসল, ধান আর গম। পাশাপাশি, সেচের জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, রাসায়নিক সারে বিপুল ভর্তুকি, কড়া কীটনাশকের জোগান, এগুলিও ধান-গম চাষে উৎসাহিত করছে চাষিদের। যে সব অঞ্চল ধান-গম চাষের অনুকূল নয়, সেখানেও এমএসপি-র আশায় চাষি ধান বুনছেন। সরকারকে ধান বিক্রির উদ্দেশ্যেই পঞ্জাবের চাষিরা ধান চাষ করেন, যদিও এক কিলোগ্রাম ধান উৎপন্ন করতে প্রায় বারোশো লিটার জল খরচ হয়। পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদরা বারবার সতর্ক করেছেন যে, ভর্তুকিতে কৃষি উপকরণ জোগানো এবং চড়া মূল্যে ফসল ক্রয়ের নীতি নানা সঙ্কট তৈরি করছে। এক দিকে পরিবেশকে বিপর্যস্ত করেছে— ভূগর্ভের জলস্তর নামছে, মাটির উর্বরতা কমছে, কমছে ফসল-বৈচিত্র। অন্য দিকে, কৃষি লাভজনক হচ্ছে না, ফলে চাষির সরকার-নির্ভরতাও কমছে না, বরং বেড়েই চলেছে। এই দুষ্টচক্র থেকে বেরোতে হলে সরকারি নীতির বদল চাই।
পরিবেশের সুরক্ষা, পুষ্টির নিরাপত্তা, যথেষ্ট উৎপাদন এবং চাষির যথেষ্ট লাভ, এগুলির প্রতি সজাগ থেকে কৃষি এবং খাদ্যের সুসংহত নীতি দরকার। ভর্তুকি, ক্রয়, বিপণন, রফতানির মতো নানা বিষয়ে পরিবর্তন প্রয়োজন। এমএসপি সংস্কার তার একটি। গত কয়েক বছরে কেন্দ্র সরকারি ক্রয়ের তালিকায় ফসলের সংখ্যা বাড়িয়েছে। রাসায়নিক-বর্জিত ‘প্রাকৃতিক’ চাষ করতে উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু এগুলি যথেষ্ট নয়। বদলাতে হবে সম্বৎসর ফসলের নকশা, যাতে চাষ বাজারমুখী হয়। যেমন, পশুখাদ্য এবং জ্বালানির জন্য ভুট্টার যত চাহিদা, তত জোগান নেই। সরকারি ক্রয়ের জন্য ভুট্টা চাষ বাড়লে তাতে বাজার থেকেও চাষির লাভ বাড়তে পারে। এমনও সওয়াল উঠেছে যে, কেবল ফসল নয়, চাষের প্রক্রিয়াও দেখতে হবে সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে। রাজনীতির জট ছাড়িয়ে এমএসপি-কে ফিরিয়ে আনতে হবে কৃষি-অর্থনীতির জমিতে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)