E-Paper

বিপর্যয়ের আগেই

শহর কলকাতা অপেক্ষায় থাকবে পরবর্তী বিপর্যয়ের। এই শহরের ভূপ্রাকৃতিক গঠন এমনই যে, এখানে জল জমার সম্ভাবনা খুব বেশি। অন্য দিকে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কলকাতার উচ্চতাও খুবই কম।

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:০৮

আপাতত শহরের বেশির ভাগ অঞ্চলে জল নেমে গিয়েছে। হয়তো পুজোর মুখে বলেই, পুরসভা বেশ দক্ষ ভাবে জঞ্জাল সাফাইয়ের কাজও করছে। মানুষও পুজোর আনন্দে মেতে উঠেছে— মুখ্যমন্ত্রীকে এ বার আর ‘উৎসবে ফিরুন’ বলতে হয়নি। ফলে আশঙ্কা হয়, সপ্তাহের গোড়ায় কলকাতা যে বিপর্যয়ে নিমজ্জিত হয়েছিল, সপ্তাহের শেষে পৌঁছতে পৌঁছতেই প্রশাসনও সে কথা ভুলে যাবে, রাজনীতিও। শহর কলকাতা অপেক্ষায় থাকবে পরবর্তী বিপর্যয়ের। এই শহরের ভূপ্রাকৃতিক গঠন এমনই যে, এখানে জল জমার সম্ভাবনা খুব বেশি। অন্য দিকে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কলকাতার উচ্চতাও খুবই কম। ফলে, প্রবল বৃষ্টি হলে এ শহরে জল জমবে, তা আশ্চর্যের নয়। এবং, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টির প্রাবল্যও বাড়তে চলেছে। এই অবস্থায় বালি অথবা উৎসবে মুখ গুঁজে থাকলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে? এই মহানগর সাক্ষী যে, জল জমে শুধু দু’এক দিন শহর অচল হয়ে যাওয়া নয়— এই বিপর্যয়ের এক দিকে রয়েছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা; আর অন্য দিকে, বাকি শহরে জল নেমে যাওয়ার পরেও কিছু কিছু অঞ্চলে দীর্ঘ দিনের ভোগান্তি, খাদ্য-পানীয়ের সঙ্কট। শহরবাসীকে এমন বিপদের মধ্যে রেখে প্রশাসন কি নিশ্চিন্ত থাকতে পারে?

প্রশাসনের চিন্তা নেই, এমন দাবি সম্পূর্ণ সঙ্গত হবে না। কিন্তু, অভিজ্ঞতা বলছে, সেই চিন্তা শুরু হয় বিপদ ঘটে যাওয়ার পর। রাস্তায় কোমরসমান জল দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর মহানাগরিক ছাতা হাতে নালা পরিষ্কার করতে নামেন; নবান্নে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়; মুখ্যমন্ত্রী খুঁজে বেড়ান বিপর্যয়ের দায় চাপানোর মতো কাউকে। এই অবস্থায় বড় জোর ঠেকনা দেওয়া যায়, কোনও ক্রমে বিপদের মুহূর্তটুকু পার করে দেওয়া যায়। এই পথে সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয়। তার জন্য প্রতি দিন সজাগ এবং তৎপর থাকা বিধেয়। প্রতি বর্ষার সূচনাতেই দেখা যায় যে, কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা আবর্জনায় বুজে গিয়েছে। নিকাশি সাফাইয়ের কাজটি আরও অনেক নিয়মিত, আরও অনেক তৎপর ভাবে করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে প্লাস্টিক ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা বিধেয়; নিকাশি-বিধি ভঙ্গ করলে নাগরিকের কড়া জরিমানাও করতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা, শহর কলকাতার শতাব্দীপ্রাচীন নিকাশি ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে। যে জনসংখ্যার শহরের জন্য সেই নিকাশি ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, এবং যে জনসংখ্যার শহর আজ তার উপরে নির্ভরশীল, দুইয়ের মধ্যে কোনও তুলনা চলে না। অবিলম্বে পরিকাঠামোর উন্নতি করতে হবে। সে দায়িত্ব রাজ্য সরকারের।

তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে নগর পরিকল্পনা কথাটি নিতান্ত গুরুত্বহীন। যার যতখানি জোর, শহরের পরিসরকে সে ততখানি দখল করে নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিতে। প্রতিটি বিপর্যয়ের পরই টের পাওয়া যায়, এই দখলদারি আসলে শহরকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। এই রাজনৈতিক দুষ্টচক্রটি ভাঙা প্রয়োজন। পূর্ব কলকাতার জলাভূমি বুজিয়ে নিউ টাউন গড়ে ওঠা নিয়ে ইদানীং প্রচুর কথা হচ্ছে। কলকাতার বাস্তুতন্ত্রে সেই জলাভূমির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। উল্টো দিকে, শহরের সম্প্রসারণের দাবিও অনস্বীকার্য। এখানেই প্রশাসনের ভূমিকা। কত দূর অবধি ছাড় দেওয়া যেতে পারে, এবং কোথায় লক্ষ্মণরেখা টানতে হবে, তার স্পষ্ট নিয়ম থাকা প্রয়োজন। এবং, রাজনৈতিক যুক্তিতে নয়, সেই নিয়ম নির্ধারণ করতে হবে বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুসারে, ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট-এর মাধ্যমে। যত দূর ছাড় দেওয়া হচ্ছে, তার ক্ষতিপূরণ বাবদ বিকল্প পরিকাঠামো নির্মাণও সেই নগরায়ণ প্রক্রিয়ারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হওয়া বিধেয়। কলকাতা আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে নষ্ট করার মতো একটি দিনও আর হাতে নেই। পরবর্তী বিপদের অপেক্ষায় না থেকে প্রশাসন এখনই সক্রিয় হোক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

drainage Heavy Rain KMC

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy