E-Paper

মানুষের উৎসবে

প্রশাসনের ব্যতিব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন আদৌ হয় না, যদি সমাজ ও পুজোকর্তারা উৎসবের প্রকৃত অর্থ এবং তার পূর্ণ রূপায়ণের পন্থাগুলি প্রসঙ্গে ওয়াকিবহাল হন।

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:১৫

দুর্গাপুজোয় সরকারি অনুদান কেন? প্রশাসন কি সাংস্কৃতিক উদ্দীপনার ওজরে আসলে রাজনৈতিক আনুগত্য নিশ্চিত করতে চায়? পুজোয় সহযোগিতার মাধ্যমে প্রকারান্তরেসংখ্যালঘুতোষক ভাবমূর্তিটির জবাব তৈরি রাখতে চায়? প্রশ্ন অনেক। কিন্তু প্রশ্ন সমালোচনা অভিযোগ সব নস্যাৎ করে প্রতি বছর উল্কাবেগে বাড়ছে পুজো অনুদান। ২০১৮ সালে ১০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু। বাড়তে বাড়তে ২০২৫-এই অনুদানের অঙ্ক পৌঁছে গিয়েছে ১ লক্ষ ১০ হাজারে। সঙ্গে জুড়েছে বিদ্যুৎ মাসুলে ৮০% ছাড়। কার্নিভালের খরচ বাড়তি। আশ্চর্য লাগে, এ কি সেই রাজ্যেরই নিশ্চিন্ত চিত্র যাকে আর্থিক স্বাস্থ্য নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে নীতি আয়োগ? রাজ্য সরকারও আর্থিক সঙ্কটের কথা তুলেছে এবং বাজেটে কিছু প্রকল্পের বরাদ্দে কাটছাঁটে সেই চিহ্ন স্পষ্ট। রাজকোষে, রাজস্বে ঊর্ধ্বমুখী ঘাটতি ও ঋণক্লান্ত একটি রাজ্যের পক্ষে উৎসবের নামে করের টাকার এই অপব্যয় চূড়ান্ত অপ্রয়োজনীয়।

এই নিয়ে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যক্ষ পূজাচারে ব্যয়ের বদলে সমাজকল্যাণমূলক কাজে অনুদান ব্যবহারে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট— যার হিসাব না দর্শালে সরকারেরও অনুদান দেওয়ার কথা নয়। ন্যায্য এই সমাধানে কমিটিগুলি খুশি ঠিকই, কিন্তু তাদের প্রতিশ্রুত কার্যতালিকা কতখানি বাগাড়ম্বর ও কতখানি বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা অস্পষ্ট। বাংলায় এখন উৎসবের রাশ থাকে ক্লাবগুলির হাতে। তাদের আচরণ ও হাবভাব যে সব সময়ই ব্যক্তিগত আমোদের পরিবর্তে সামাজিক দায়বদ্ধতাকে বেশি গুরুত্ব দিতে অভ্যস্ত, এমন কথা হলফ করে বলা যায় না! ফলে, অনুদানের অর্থ উপযুক্ত খাতে খরচ হচ্ছে কি না যাচাই করার জন্য আলাদা কমিটির প্রয়োজন। কিন্তু, প্রায় ৪৫,০০০ ক্লাবের কোনটি সম্বৎসর ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে অভিযানে, কোনটি পুজোর সময় নারীসুরক্ষার প্রকল্প স্থাপন করে, কোনটি বছরভর রক্তদান শিবির আয়োজনে, মেধাবীদের পড়ার খরচ জুগিয়ে বা অসুস্থদের হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে এবং কোনটিই বা এর সবই একটু একটু করার মাধ্যমে অর্থের সদ্ব্যবহার করছে তার অনুপুঙ্খ নজরদারি— কার্যত অসম্ভব। ফলে, তহবিল গরমিলের আশঙ্কা অমূলক নয়।

প্রশাসনের ব্যতিব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন আদৌ হয় না, যদি সমাজ ও পুজোকর্তারা উৎসবের প্রকৃত অর্থ এবং তার পূর্ণ রূপায়ণের পন্থাগুলি প্রসঙ্গে ওয়াকিবহাল হন। বিশ্বের প্রতি সংস্কৃতিতেই আর্ত, পীড়িতের চোখের জল মুছে তাকে নিয়ে খুশির রোশনাইতে একযোগে মেতে ওঠাকে উৎসবের পূর্ণ উদ্‌যাপন বলে মনে করা হয়। এ দেশেও সেই একই ধারা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শারদোৎসব নাটকের মধ্যে যে দর্শনের স্পষ্ট প্রতিফলন ছিল। উপনন্দ ঋণশোধের তাড়নায় পুঁথি লিখছে, হাত লাগান রাজসন্ন্যাসী, ছেলের দল। সবাই মিলেমিশে কাজ শেষ করে দশে মিলে নৌকা বাচ করলে তবেই না ‘বেশ মজা’! আনন্দধারা থেকে এক জনও যদি বাদ পড়ে, তবে তা বিচ্ছিন্ন মানুষের উল্লাস হয়ে থেকে যায়, সার্থক উৎসব হয় না। আর, অকালবোধনের আগে প্রকৃতিও ‘ঋণশোধ’ই চায়। কখনও ভূমিকম্প, কখনও প্লাবন অথবা আকাশভাঙা বৃষ্টি, কখনও কারও অদৃষ্টের ফের। সেই সব বিমর্ষ মানুষের কষ্ট হ্রাস করতে না পারলে উৎসব সর্বজনীন হবে কী করে? প্রশাসন সুযোগ দিচ্ছে, বিচারবিভাগ পথ দেখিয়েছে, এ বার কর্তব্য মিটিয়ে মেঘের কোলে রোদ হাসার দৃশ্যটি দেখতে চায় কি নাগরিক সমাজ?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Durga Puja Government Schemes

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy