বাজির ধোঁয়ায় যে প্রতি বছর দীপাবলির সময়ে শ্বাসকষ্ট, হৃদ্রোগ বৃদ্ধি পায়, পশুপাখির জীবন অতিষ্ঠ হয়, বহু বার বিশেষজ্ঞরা তা নিয়ে সতর্ক করেছেন। তা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার উল্টো পথে হাঁটা অভ্যাস করেছে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যেমন বাজির শব্দের ঊর্ধ্বসীমাকে ৯০ থেকে ঠেলে ১২৫ ডেসিবেল করে দিয়েছিল। এই ৩৫ ডেসিবেল অতিরিক্ত ছাড়ের অর্থ বেশ কিছু নিষিদ্ধ বাজির উৎপাদন, মজুত এবং বিক্রিকে বৈধ তালিকায় টেনে আনা। খাতায়-কলমে ‘ছাড়-না-পাওয়া’ বাজিগুলিরও শব্দ ও দূষণমাত্রা নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকছে কি না, সর্বত্র নজরদারি চলে না। পুলিশ-প্রশাসন শুধুমাত্র দীপাবলির আগে কিছু পরিচিত জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে নিষিদ্ধ বাজি আটক করে, খানিক ধরপাকড় চালায়। যদিও যারা বছরভর আইন অমান্যে সিদ্ধহস্ত, তারা এই সময়টিতেই প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ বাজির ভান্ডার সাজিয়ে বসবে— এমন আশা করা কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় নয়। স্বাভাবিক ভাবেই, রাজ্যের বিভিন্ন খাঁজখোঁজে নিষিদ্ধ বাজি বিক্রি চলে অবাধে। সেই বাজি আমোদপ্রিয় জনগণের হাতে পৌঁছে যায় যথাসময়ে। পরিণতি, সকলেরই জানা।
দূষণের মতো গুরুতর বিষয়ে রাজ্য প্রশাসনের এমন নির্লিপ্তি, আইন না মানাকে প্রকাশ্যে প্রশ্রয় দান এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করে। প্রশাসনিক এবং নাগরিক অবিমৃশ্যকারিতায় ইতিমধ্যেই যে ভবিষ্যতের ভিত্তিভূমিটি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। তবু তাকে খানিক সংশোধনের চেষ্টায় কিছু সদর্থক পদক্ষেপ করা হয়েছিল বিচারবিভাগের উদ্যোগে। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট এবং ২০২৩ সালে হাই কোর্ট বাজি নিয়ে বেশ কিছু কঠোর নির্দেশ দেয়। সম্প্রতি দিল্লির ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট দিনে সর্বমোট তিন ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে শুধুমাত্র সবুজ বাজির জন্য। এই রাজ্যে অবশ্য আগেই আদালতের নির্দেশ ছিল, দীপাবলির রাতে শুধুমাত্র দু’ঘণ্টা সবুজ বাজি ফাটানো যাবে। কিন্তু সবুজ বাজির সংজ্ঞা নিয়ে ধোঁয়াশা বিস্তর। আগে বাজির বাক্সের গায়ের কিউআর কোড স্ক্যান করলে কোন কোন উপাদান দিয়ে বাজিটি তৈরি, প্রস্তুতকারীর নাম জানা যেত। কিন্তু সেই কোড বানানো বন্ধ করেছে ‘নিরি’। গত দু’বছরে অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ দমকল বাজি পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেও সবুজ বাজি পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘নিরি’ বা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রতিনিধিরা সেখানে সময়মতো হাজির হন না। এমতাবস্থায়, আদালতের নির্দেশ পালন কত দূর হবে, প্রশ্ন থেকে যায়।
বিষয় যখন পরিবেশ দূষণ, তখন বাজি পুরোপুরি নিষিদ্ধ হচ্ছে না কেন— তার উত্তর সম্প্রতি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। জানিয়েছে, বাজি নিষিদ্ধ হলে চোরাই পথে তা বাজারে আসবে। এ কথা সত্য। কিন্তু এটাও সবিনয়ে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসনিক নজরদারির বিষয়টি শূন্য। পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যে বৈধ অনুমোদনপ্রাপ্ত বাজি কারখানা সরকারি নথি অনুযায়ী ছ’টি। বাস্তবে তা তিন হাজারের কাছাকাছি। অর্থাৎ, প্রায় সবই অবৈধ। প্রত্যাশিত যে, সেই অবৈধ কারখানায় ‘বৈধ’ বাজি তৈরি হবে না। তা ছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাড়ির অভ্যন্তরে যত্র তত্র কারখানাগুলি চলে। গত কয়েক বছরে বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে শিশু-সহ বহু প্রাণহানি ঘটেছে। শোনা গিয়েছে অন্তঃসারশূন্য রাজনৈতিক বুলিও। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশকে বাজি রাখার খেলা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুক্তি নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)