পশ্চিমবঙ্গে হুমকি-সংস্কৃতি, ধর্ষণ-সংস্কৃতির দৌরাত্ম্য যে অপ্রতিহত, তা দেখাল দক্ষিণ কলকাতার সরকারি আইন কলেজের মধ্যে এক ছাত্রীর গণধর্ষণ। শাসক দলের সঙ্গে প্রধান অভিযুক্তের ঘনিষ্ঠতা, কলেজে তার অপরিমিত প্রতাপ, কলেজ চত্বরের মধ্যে নারী-নিগ্রহের অকল্পনীয় ঔদ্ধত্য— কসবার কলেজের ঘটনার প্রতিটি বিবরণ গত বছরের আর জি কর ঘটনাকে মনে করাতে বাধ্য। আইনের কলেজ চত্বরে কলেজ-কর্মীর ছাত্রীর গণধর্ষণ ও তার ভিডিয়ো প্রকাশের ভয় দেখানো— এমন ঘটনা এ রাজ্যে ব্যতিক্রমী নয়। বার বার দুষ্কৃতীদের ঔদ্ধত্যের মূল খুঁজতে গিয়ে মিলছে তাদের এই প্রত্যয় যে, পুলিশ ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না। এই হল ধর্ষণ-সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির কারণেই, ইতিমধ্যে আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণ আর জি কর কাণ্ডের যেটুকু বিবরণ এনেছে, তাতে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। যেমন, কী করে একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ চিকিৎসক, ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারল? সে দিন শাসক দল তৃণমূল নানা কৌশলে সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়েছে। মেডিক্যাল কলেজে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের ব্যাপকতা স্বীকার করতে বাধ্য হলেও, ৯ অগস্ট ২০২৪, পড়ুয়া-চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের সঙ্গে ওই ক্ষমতা-দূষিত পরিবেশের সব সম্পর্ক অস্বীকার করেছে। অথচ সম্পর্ক নেই, তা কি সম্ভব? সরকারি শিক্ষাক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্রকে দলীয় দুর্বৃত্তের মুক্তক্ষেত্র করে তোলা যেমন অবাধ দুর্নীতির উপায়, তেমনই ধর্ষণ-খুনের মতো অপরাধেরও প্রাক্-শর্ত। প্রসঙ্গত, সে দিন রাজ্য সরকার ও শাসক দল বিনষ্ট প্রমাণের সুযোগে, আর প্রশাসনিক ক্ষমতার জোরে, ধর্ষণের সঙ্গে দূষিত কর্মসংস্কৃতির যোগ নস্যাৎ করেছিল। বরং আর জি করের চিকিৎসক, ছাত্রছাত্রীদের ভীতিপ্রদর্শনে, হয়রানিতে অভিযুক্তদের ফের মেডিক্যাল কলেজে, নানা প্রশাসনিক সংগঠনে, কমিটিতে ফিরিয়ে এনেছিল।
ফলে সারা রাজ্যে এই বার্তাই গিয়েছিল যে, শাসক দলের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় যারা রয়েছে, তারা যত বড় দুষ্কর্মই করুক না কেন, তাদের স্পর্শ করার সাধ্য নেই কারও। প্রাতিষ্ঠানিক বিধি, সরকারি নিয়ম, আইনের ধারা, কোনও কিছুই যেন কিছু নয় যদি ধর্ষক বা খুনির মাথায় থাকে দলীয় রাজনীতির হাত। প্রতি দিন বিভিন্ন সরকারি কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাক্ষেত্রে সে ধারণা পুষ্ট করেছে অভিযুক্তের মতো মতো অজস্র দলীয় কর্মী। আইন কলেজে ধর্ষণের মূল অভিযুক্ত অভিযুক্ত অপরাধী কি না, তা বিচারের অধিকার নাগরিকের নেই। তা নির্ধারণ করবে আদালত। কিন্তু নাগরিক অবশ্যই প্রশ্ন করতে পারেন পুলিশকে— খুন, ধর্ষণ, র্যাগিং-এর এফআইআর যার নামে, সে কেন কখনও গ্রেফতার হয়নি? প্রশ্ন করতে পারেন কলেজ কর্তৃপক্ষকে— এমন ‘দাগি’ এক ব্যক্তিকে কোন মার্কশিট বা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়েছিল? পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, কলেজ কর্তৃপক্ষের নীরব নতিস্বীকার, এ সবই যৌনহিংসার পথ করে দিয়েছে। প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ থেকে কলেজকাণ্ডে অভিযুক্ত অস্থায়ী কর্মী , এদের ক্ষমতার উৎস শনাক্ত করলেই স্পষ্ট হবে, কেন নিজের হাসপাতালে, নিজের কলেজে ধর্ষিত হতে হচ্ছে মেয়েদের।
গণ্ডূষমাত্র জলে আকাশ-দর্শনের মতো, রাজ্যে নারীহিংসার বৃহৎ চিত্রটির সারসংক্ষেপ দেখিয়ে দিল কসবা আইন কলেজের ধর্ষণকাণ্ড। নিরাপত্তা রক্ষীর ঘরেই যে মারধর, নির্যাতন হল এক নিরপরাধ মেয়ের উপর, তা যেন প্রতীকী। আর জি কর কাণ্ডে এক নিরাপত্তা রক্ষীই ধর্ষণে অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছে। আর আইন কলেজে রক্ষীর ঘরে ঘটল ধর্ষণ। রক্ষীর ভূমিকা কী, তার উত্তর মিললেই বা কী— এ রাজ্যে মেয়েদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাটিই যেন ‘নেই’ হয়ে গিয়েছে। কেবল আইন কলেজের নির্যাতিতা ছাত্রীর ধর্ষকের নয়, রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থার এই প্রকাণ্ড স্খলনের, এই ধর্ষণ-সংস্কৃতির বিচার চাইছে এই রাজ্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)