E-Paper

গাড়ির মৃত্যু

ক্ষুদ্র রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে যদি গোটা পরিস্থিতিটির দিকে তাকানো যায়, তা হলে বোঝা যাবে, ভারতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ঠিক কোন পথে চলে। যানবাহনের দূষণ অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন।

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৫ ০৬:৩৩

জীবন-সায়াহ্নে উপনীত গাড়ির আয়ুষ্কাল বাড়ল মাসচারেক। কমিশন ফর এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট (সিএকিউএম) জানিয়েছে, পয়লা নভেম্বর থেকে জীবন-সায়াহ্নে উপনীত গাড়িকে (এন্ড অব লাইফ ভেহিকল, অর্থাৎ দশ বছরের বেশি পুরনো ডিজ়েল গাড়ি, এবং পনেরো বছরের বেশি পুরনো পেট্রল গাড়ি) তেল বিক্রি করা বন্ধ হবে দিল্লি এবং ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়নের আরও পাঁচটি হাই ভেহিকল ডেনসিটি জেলায়। এ মাসের গোড়ায় দিল্লিতে এই ধরনের গাড়িকে তেল বিক্রি করা বন্ধ হয়েছিল— তার পর বিশেষত মধ্যবিত্তদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়। সম্ভবত এই প্রতিক্রিয়ার রাজনৈতিক অভিঘাত আঁচ করেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্ত এনএকিউএম-এর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। আপাতত চার মাসের জন্য সিদ্ধান্তটি স্থগিত হয়েছে— আঁচ করা চলে যে, রাজনীতির স্বার্থ স্থির করবে, ভবিষ্যতে মেয়াদ আরও বাড়বে কি না। কিন্তু, ক্ষুদ্র রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে যদি গোটা পরিস্থিতিটির দিকে তাকানো যায়, তা হলে বোঝা যাবে, ভারতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ঠিক কোন পথে চলে। যানবাহনের দূষণ অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। তার যথাযথ সমাধানসূত্র অবশ্যই নির্ধারণ করা প্রয়োজন। কিন্তু, যে সিদ্ধান্তে ভাবনাচিন্তার লেশমাত্র চোখে পড়ে না, তেমন নীতি দিয়ে কোনও সমস্যারই সমাধান হয় না, এটিরও হবে না।

প্রথম কথা হল, কোন গাড়ি রাস্তায় চলবে, আর কোনটি চলবে না, তা নির্ধারণের একমাত্র মাপকাঠি হওয়া উচিত সেই গাড়ির দূষণ মাত্রা। ভারতের সব গাড়িকেই একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর দূষণ পরীক্ষা করাতে হয়, এবং তাতে উত্তীর্ণ না হলে সে গাড়ি আইনত রাস্তায় চালানো যায় না। এর বাইরেও রাস্তায় বিভিন্ন সময় দূষণ পরীক্ষা হয়। কাজেই, কোন গাড়ি দূষণ ছড়াচ্ছে, এবং কোন গাড়ি পরিবেশের পক্ষে নিরাপদ, তা বোঝার ব্যবস্থা ভারতে ইতিমধ্যেই আছে— গাড়ির বয়স দেখে অনুমান করার প্রয়োজন নেই। দূষণের মাত্রা বহুলাংশে নির্ভর করে গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের উপরে। যথাযথ ভাবে রাখা ১৫ বছর বয়সি গাড়ির দূষণ অযত্নে রাখা পাঁচ বছর বয়সি গাড়ির চেয়ে কম হতে পারে, অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই তা মানবেন। প্রশাসন যদি দূষণের বিষয়ে আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে মনস্থ করে, তা হলে আইন পাল্টে দূষণের সহনীয় মাত্রাকে আরও কমিয়ে আনা যেতে পারে, এবং যে গাড়ি তাতে ফেল করবে, তাকেই নিষিদ্ধ করা যায়। কিন্তু, তার পরিবর্তে গাড়ির বয়স দেখে তেল বিক্রি বন্ধ করা একটি অবিবেচনাপ্রসূত নীতি। এবং, তার সমস্যাও অনেক— পাশের রাজ্য থেকে তেল কেনা, তেলের কালো বাজার, এবং পেট্রল পাম্পের কর্মীদের জন্য নিয়মিত অশান্তির ব্যবস্থা পাকা করা।

যানবাহনের দূষণ সত্যিই কমাতে চাইলে ব্যক্তিগত পরিবহণের পরিবর্তে নজর দেওয়া উচিত গণপরিবহণে। দিল্লির উদাহরণটিই নেওয়া যাক। গত দু’দশকে সে শহরে মেট্রো পরিষেবা ব্যাপক হয়েছে। কিন্তু, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবনতি ঘটেছে বাস পরিষেবার। যথেষ্ট আরামদায়ক এবং নির্ভরযোগ্য গণপরিবহণের ব্যবস্থা হলে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের প্রবণতা যে কমে, দুনিয়ার বহু উন্নত দেশেই তার নজির রয়েছে। অন্য দিকে, শহরের প্রাণকেন্দ্রে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিবিধ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করাও বিধেয়— যেমন, চড়া পার্কিং ফি, সেন্ট্রাল বিজ়নেস ডিস্ট্রিক্ট-এ ব্যক্তিগত গাড়ি-মুক্ত অঞ্চল ইত্যাদি। শুধু দিল্লি নয়, এই একই নীতি ভারতের সব বড় শহরেই প্রয়োগ করা বিধেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, কার্যত প্রতিটি শহরই এর উল্টো দিকে হেঁটে ক্রমেই ব্যক্তিগত গাড়ি-নির্ভর হয়ে উঠছে। এই পথগুলিতে না হেঁটে শুধু পুরনো গাড়ি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিলে কেউ সন্দেহ করতে পারেন, পরিবেশ রক্ষা অজুহাতমাত্র, আসল উদ্দেশ্য গাড়ির বিক্রি বাড়ানো। নাগরিকের এই সন্দেহটি যে অমূলক, তা প্রমাণ করার দায়িত্ব প্রশাসনের।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Car Transport

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy