জলের এক নাম জীবন বটে, তবে মুম্বইয়ের মতো সমুদ্র-উপকূলবর্তী, এবং প্রতি বছর বর্ষায় নিয়ম করে অতিপ্রবল বা তার কাছাকাছি বৃষ্টিপাতের মোকাবিলা করা শহরের বাসিন্দারা বলবেন, জল তাঁদের কাছে মরণও। প্রিন্সটন ও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক সম্প্রতি এ শহরের পুরসভার মৃত্যু-তথ্যের পাশাপাশি বৃষ্টিপাতের তথ্য মিলিয়ে দেখে জানিয়েছেন, প্রতি বছর মুম্বইয়ে প্রায় ২৫০০ মানুষের মৃত্যু হয় বর্ষার বৃষ্টিজনিত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা কারণে। নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁদের গবেষণাপত্রে যে পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে তাতে দুশ্চিন্তা জাগতে বাধ্য: মু্ম্বইয়ের বর্ষায় দশ বছরে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, ক্যানসারেও তত নয়! দেখা যাচ্ছে, অতিপ্রবল বা তার কাছাকাছি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হওয়ার পর অন্তত পাঁচ সপ্তাহ পর্যন্ত অধিক মৃত্যুহার বজায় থাকছে। দেখা যাচ্ছে— পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে বৃষ্টিজনিত বর্ধিত মৃত্যুহার সর্বোচ্চ, ও-দিকে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের তুলনায় বেশি মারা যাচ্ছেন নারীরা— এবং অত্যধিক মৃত্যুর ঘটনাগুলির ৮০ শতাংশই ঘটছে মুম্বইয়ের বস্তি অঞ্চলে।
এই তথ্য যে সত্যকে তুলে ধরে তা শুধু মুম্বই নয়— ভারতের, এমনকি জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শিকার বিশ্বের যে কোনও নগরেরই স্বীকার্য। বর্ষার বৃষ্টিকে ‘বাৎসরিক ঘটনা’ বলে প্রকৃতি বা নিয়তির হাতে ছেড়ে দেওয়ার রোগ প্রশাসনের বরাবরই, বিশেষত ভারতে। বৃষ্টি ও অতিবৃষ্টি নিশ্চয়ই প্রকৃতিনির্দিষ্ট ঘটনা, তা বলে নগরের পূর্ত ও নিকাশি পরিকাঠামো তার মোকাবিলায় তৈরি থাকবে না— বর্ষার জলে ডুবে, তড়িদাহত হয়ে বা অন্য দুর্ঘটনায় নাগরিকের মৃত্যুকে স্রেফ দুর্ভাগ্যজনক দাগিয়ে ও ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায় সারার চেষ্টা করবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। তথ্য থেকে স্পষ্ট, বৃষ্টিজনিত অত্যধিক মৃত্যুর পিছনে যে কোনও পুর-প্রশাসনের অপদার্থতা ও ব্যর্থতা একটা বড় কারণ। গবেষকেরা যা দেখিয়েছেন চরম স্বাস্থ্য সঙ্কটের দিক থেকে, তাকে আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের দিক থেকেও দেখা দরকার— বর্ষায় বস্তি অঞ্চলের মানুষের, বা নারী ও শিশুর অধিক মৃত্যুর পিছনে পুর-পরিকাঠামো উন্নয়নের অভাব, নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বাস্তবতা কোনও প্রশাসনই অস্বীকার করতে পারবে না।
ভারতীয় প্রশাসকদের সঙ্গে বিদেশের গবেষণার বড় একটা সদ্ভাব নেই। অথচ এই গবেষণা তাঁদের শিক্ষণীয় হতে পারত, কারণ প্রশাসন কোন পদক্ষেপ করলে এই মৃত্যুমিছিল ঠেকানো যেতে পারে তার আভাসও তাতে দেওয়া আছে। গোড়ার কাজটি হল দু’টি শৃঙ্খল ভেঙে দেওয়া। এক, অতিবৃষ্টিপাত এবং বন্যা/জল জমার যোগ; দুই, বন্যা/জল জমা এবং নাগরিক-মৃত্যুর যোগ। নিকাশি পরিকাঠামো উন্নত করলে প্রথমটি ভাঙা যাবে, আর দ্বিতীয়টি ভাঙা পড়বে পোক্ত আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক ঘটনাজনিত রোগ-অসুখের মোকাবিলায় সদাপ্রস্তুত চিকিৎসা-ব্যবস্থা ও উন্নত জনস্বাস্থ্যের বন্দোবস্ত নিশ্চিত করে। সত্যিই তা করতে পারলে এক দিন বর্ষাপীড়িত শহরে বিদ্যুৎস্তম্ভ ছুঁয়ে বা জমা জলে লুকোনো তারে একটি মানুষেরও মৃত্যু হবে না; ডায়রিয়া, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েডের মতো রোগ-অসুখেও মৃত্যু কমবে। নাগরিকের জীবন যেখানে প্রশ্নের মুখে, সরকার ও প্রশাসনের নির্লিপ্তি বা গড়িমসি সেখানে ক্ষমাহীন অপরাধের শামিল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)