সবার ক্ষেত্রে প্রকৃতি কি সমান নিষ্ঠুর? দুনিয়ার যে কোনও প্রান্তে থাকা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়া নারীরা এই প্রশ্নের উত্তর জানেন। প্রকৃতির রোষও নারীর উপরেই প্রবলতর। বিশেষত, আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা শ্রেণিভুক্ত পরিবারের মেয়েদের উপরে। যেমন, কেনিয়া, ইথিয়োপিয়া আর সোমালিয়ায় পর পর চার বছর অনাবৃষ্টির ফলে যে খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, গত সাত দশকে যেমন খরা এই অঞ্চলে হয়নি, তাতে অসংখ্য মেয়েকে স্কুল ছাড়তে হয়েছে, নাবালিকা অবস্থাতেই তাদের বিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য, প্রকৃতি তাদের এ অন্ধকারে ঠেলে দেয়নি— দিয়েছে পরিবার, সমাজ, এবং তার নিয়ন্ত্রক পিতৃতন্ত্র। কেন, সে কারণ বোঝার জন্য আফ্রিকার সঙ্গে বিন্দুমাত্র পরিচয় থাকার প্রয়োজন নেই, আমাদের চারিপাশে তাকানোই যথেষ্ট। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা নিতান্ত বাড়তি ব্যয় হিসাবে গণ্য, তাদের লেখাপড়া তো বটেই। ফলে, খরার মতো কোনও বিপর্যয়ের কারণে যদি পরিবারের আয় কমে যায়, জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হয়, তবে প্রথম যে খরচটি ছেঁটে ফেলা দস্তুর, তা হল মেয়েদের লেখাপড়া। তাতেও না কুলোলে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়, যাতে অন্তত এক জনের খাবার খরচ বেঁচে যায়। বিয়ে হয়েও যায়, কারণ পাত্রপক্ষ জানে, বৌ মানে বিনা পারিশ্রমিকে যাবতীয় কায়িক শ্রমের জোগানদার— বিশেষত খরা আক্রান্ত অঞ্চলে যখন বহু দূর থেকে পানীয় জল টেনে আনতে হয়, তখন এই শ্রমিকের দাম আছে বটে। মহারাষ্ট্রের গ্রামে ‘পানি বাই’ বা জল টানার জন্য বিয়ে করে আনা বৌয়ের কথা মনে পড়তে পারে কারও কারও। ছবিটির মাপ দেশের রাজনৈতিক গণ্ডি টপকে পৌঁছে যায় দূরদূরান্তে, আবিশ্ব।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ইউএনডিপি-র ২০১৯ সালের একটি রিপোর্ট জানিয়েছিল, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যত প্রাণহানি ঘটে, তার ৬০ শতাংশই মহিলা। অন্য একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে বিপাকে পড়ার সম্ভাবনা পুরুষদের তুলনায় মহিলা এবং শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি। বিশেষত, পুরুষ অভিভাবকহীন পরিবারের ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা তীব্রতর। আবারও, প্রকৃতির দুষ্ট পক্ষপাত নয়, মহিলাদের এই বিপন্নতার মূলে রয়েছে সেই অকৃত্রিম ব্যাধিটি— পিতৃতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা। পুরুষদের তুলনায় মহিলারা অর্থকরী ক্ষেত্রে কাজ করেন কম; আর, কাজ করলেও পরিবারের অভ্যন্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদের অধিকার কম। ফলে, যে সিদ্ধান্ত স্থির করে দেয় কে বাঁচবে আর কে বাঁচবে না, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার প্রায় ব্যতিক্রমহীন ভাবে পুরুষের। বহু ক্ষেত্রে শিক্ষার অভাব, তথ্যের অভাবও মেয়েদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে, তাঁদের অপারগ করে তোলে। যে বিপর্যয় মুহূর্তে ঘটে, সেখানেও যেমন পুরুষের প্রাণ আগে বাঁচে, তেমনই খরার মতো যে বিপর্যয় ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় মানুষকে, সেখানেও বহু ক্ষেত্রেই বিপজ্জনকতর কাজগুলি এসে পড়ে নারীর ঘাড়ে। বিপর্যস্ত এলাকা থেকে অন্যত্র পরিযাণের ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার পায় পুরুষ। যে পরিবার সক্ষম পুরুষ অভিভাবকহীন, সেখানে পরিস্থিতি করুণতর— পরিবেশ বিপর্যয়ের সঙ্গে লড়ার আর্থিক সঙ্গতিই থাকে না বহু ক্ষেত্রে; পরিযাণের জন্য প্রয়োজনীয় টাকাও নয়। দারিদ্র বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাস করে আরও একটি বিপদ— শারীরিক ভাবে নিগৃহীত হওয়ার, ধর্ষিত হওয়ার বিপদ। বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গ্রাম থেকে শহরের ফুটপাতে ঠাঁই পাওয়া মহিলা সব দেশেই সহজ শিকার।
লিঙ্গ বৈষম্যের এই প্রশ্নটির থাকার কথা ছিল পরিবেশ নীতির একেবারে কেন্দ্রে— কারণ, নেহাত পাটিগণিতের হিসাবেই যাঁরা মোট জনসংখ্যার অর্ধেক, তাঁদের বিশেষ বিপন্নতার কথা মাথায় না রাখলে নীতি অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য। কিন্তু, তেমন নীতি প্রণয়ন বুঝি অন্য কোনও সাধনার ফল। নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি যে পরিবেশ নীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হতে বাধ্য, রাষ্ট্রনায়করা এখনও সেই উপলব্ধিতে পৌঁছননি; অদূর ভবিষ্যতে পৌঁছবেন, তেমন আশাও অতি ক্ষীণ। ফলে, পরিবেশ বিপর্যয়ের বিপন্নতা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা মেয়েদের নিজস্ব সংগ্রাম হয়েই থেকে গিয়েছে। এমনকি, তাঁদের এই বিপন্নতা যে একটি বৃহত্তর প্রশ্নের অঙ্গ, রাষ্ট্রের অক্ষমণীয় ব্যর্থতা, মূলধারার রাজনীতি সে কথাটিও স্বীকার করতে পারে না। মেয়েরা জানেন, খরা হলে দূর থেকে জল টেনে আনাই তাঁদের ভবিতব্য— পথে আক্রান্ত হলে তাও মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ান্তর নেই। মেয়েরা জানেন, মেয়ে হয়ে জন্মালে মেনে নিতে হয় অনেক কিছুই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)