কালীপুজো, ভাইফোঁটাও চলে গেল। মহালয়ায় মাতৃপক্ষের শুরু থেকে এক মাস ধরে আমরা দেবীরূপে মাতৃশক্তির আরাধনা করলাম। কিছু ক্ষণের জন্য হলেও, ধর্মের অজুহাতে হলেও, মেনে নিলাম: মায়েরা অসুর দমন করতে পারেন, দশ হাতে অস্ত্রও ধরতে পারেন তার জন্য। এ ক্ষেত্রেও অবশ্য দশ হাতের বিষয়টিকে আমরা নিজেদের সুবিধের জন্য বেঁকিয়ে, মেয়েদের ‘দশভুজা’ বলে তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে চাই। আর আমাদের মেয়েদের কোষে সঞ্চিত স্মৃতি (জিন মেমরি) যেহেতু তুমুল অসম্মানের, তাই সামান্য সম্মান পেলেই হড়বড়িয়ে কাজ দেখাতে শুরু করি। মনে করিয়ে দিই না, মনে থাকে না, মা দুর্গার দশটা হাত থাকাটাই প্রতীক হিসেবে শেষ গুরুত্বপূর্ণ কথা নয়, গুরুত্বের বিষয় ওই দশ হাতে থাকা দশটি অস্ত্র। অশুভ দমনের শক্তি, ভাল থাকার বর দানের শক্তি। এই শক্তি, এই ক্ষমতা অবশ্য কাঙ্ক্ষিত— এই ক্ষমতা কেড়ে নিলে মায়েরা নিরস্ত্র। মা নিরস্ত্র নন, মায়েদের নিরস্ত্র থাকার কথা নয়। সব সময়েই এটা মনে রাখার কথা, বিশেষত এই মাসে। যে মাস শুধু উৎসবের মাস ছিল না, যে মাস শুধু দেবীকে পুজো করে কর্তব্য চুকিয়ে দেওয়ার নয়। এই মাস ঘোষিত ভাবে পারিবারিক হিংসা-বিরোধী মাসও ছিল। এই অক্টোবর মাস, যা ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাওয়ারনেস মান্থ’ বলে পালিত হয়। আলাদা করে ঘোষণা করা হয়তো অনুচিত, তবু যে দেশের লোকেদের নিজেদের সুবিধামত বধির হয়ে যাওয়ার অভ্যেস আছে (প্রয়োজনে মূক-ও) তাদের জন্য কখনও কখনও উচ্চকিত ঘোষণার প্রয়োজন আছে।
কেনই বা এই উচ্চকিত ঘোষণার প্রয়োজন? কখন কখন মূক-বধির হই আমরা? ভারতে ৬২% মহিলা পারিবারিক শারীরিক হিংসার শিকার হন, এবং ভীতিপ্রদ ভাবে এই সংখ্যা গত ৫ বছরে ৫.৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়াও, ৭১% ভারতীয় মহিলা মানসিক অত্যাচারের শিকার হন। এবং, এর মধ্যে মাত্র ২২% শেষ অবধি নথিভুক্ত হতে পারে।
এ বার আসে ‘কেন’র প্রশ্ন, যা বহু বার আলোচিত হয়েছে এবং যার কোনও উত্তর নেই। কেন পারিবারিক হিংসা অথবা কেন তা নথিভুক্ত হয় না— এই দুই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে,
এ দেশে কন্যাসন্তানের জন্ম (বা তাকে জন্মাতে না দেওয়া) থেকে শুরু করে, তার শিক্ষা, বিবাহ অবধি বৈষম্যের পরিচিত ইতিহাস পেড়ে আনতে হবে।
তা হলে এখন উত্তর খুঁজছি কেন? নতুন করে কী ঘটল এই দেবীপক্ষের মাসে? পারিবারিক হিংসা-বিরোধী মাস ঘোষণা করে আমরা কোনও আলোর দিশা দেখতে পেলাম? ভারতে মধ্যবয়স্ক মহিলাদের পাঁচের মধ্যে চার জন অর্থনৈতিক অত্যাচারের শিকার হন, এবং পাঁচের মধ্যে তিন জন মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের। তবে আশার কথা, এই বিগত ৭ বছরে ৪১% হার বেড়েছে সেই মধ্যবয়স্ক মহিলাদের, যাঁরা সাহস করে তাঁদের অত্যাচারের কথা জানাতে পেরেছেন।
শুধু এই ঘটনাদের কথা আলাদা করে বলছি কেন? আর এত হতাশ হওয়ারই বা কী আছে? এই তো ভার্চুয়াল পৃথিবীতে শুরু হয়ে গেছে ‘আমিও আছি’ (#metoo) ঘটনার ঘনঘটা। সবাই নানা ভাবে বলছেন তাঁদের ক্ষেত্রে ঘটা যৌন হেনস্তার কথা। তাঁরা যখন অমন চাপা দুঃখের কথা সর্বসমক্ষে বলে ফেলতে পারেন, তা হলে পারিবারিক হিংসার কথা না বলার কী আছে? যাঁরা যৌন হেনস্তার কথা বলেন তাঁদের খাটো করছি না। তাঁদের নিশ্চয়ই দুঃখের স্মৃতির সঙ্গে সহবাস করতে হয়, কিন্তু পারিবারিক হিংসার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহবাস করতে হয় সেই মানুষটির সঙ্গে, যিনি নারীটির গায়ে সকালে গরম জল ঢেলে দিয়েছিলেন। হার্ভে ওয়াইনস্টেইন কত অভিনেত্রীকে ধর্ষণ করেছেন জেনে আমরা আহা-উহু করছি, কিন্তু নিয়মিত ধর্ষিত হবেন জেনেও বিছানায় যেতে বাধ্য হন ৩৬.৭% গৃহবধূ।
সারা দেশ যখন ‘জয় মা জয় মা’ বলে হুংকার দিচ্ছে আর ঘরে ফিরে অসুর হয়ে উঠছে অনায়াসে, তখন অলৌকিক অস্ত্রের সাহায্য ছাড়াই অসুরদলনী হয়ে উঠেছেন এই মহিলারা, যাঁরা সাহস করেছেন নিজেদের পারিবারিক অত্যাচারের কথা বলার— কম কথা? উৎসবের আলোতে আমরা কেউ এঁদের কথা মনে রাখিনি, তবু এঁরা দমেননি। যখন আমরা অনায়াসে পুজোর শাড়ি, ধনতেরাসের গয়নার মূল্যে নিজেদের ইচ্ছা, অস্তিত্বকে বাণিজ্যে পর্যবসিত হতে দিচ্ছি— ঠিক তখনই এঁরা আলো-বাতাসের জন্য লড়ছেন। এ আলোবাতাসটুকু সম্মানের, বাজারে কেনা নয়।
শুরুতে অস্ত্রের কথা হচ্ছিল। আমরা পড়াশোনা শিখেছি, হয়তো উপার্জনও করি। অর্থাৎ অস্ত্র আমাদের হাতে আছে। কিন্তু কখনও ভয়ে সেই অস্ত্র লুকিয়ে রাখছি, কখনও ইচ্ছে করে বিসর্জন দিচ্ছি। সমান হওয়ার সাহস নেই, মনে মনে সেই দেবী হওয়ার লোভ।
আমরা দেবী দুর্গাকে পর্যন্ত দশমীর শেষে কনকাঞ্জলি দিইয়ে নিই, প্রতি বছর তাঁর ভাত-কাপড়ের ঋণ শোধ করাই। কেঁদে কেঁদে বরণ করি আর যা-ই করি, পাঁচ দিনের মাথায় তাঁকেও বাপের বাড়ি থেকে পার করে দিই। তাঁকে ধূপধুনো দিয়ে বেশি বেশি আরতি করার কারণ নাকি: দেবীর ঘুম পেয়ে যাবে আর তাঁর কষ্টের অনুভূতি হবে না।
সব পুজো-আচ্চার পরে, লোকায়ত বিশ্বাসের আড়ালে দেবী দুর্গাকে পর্যন্ত রেয়াত করিনি। উৎসব শেষ হলেও পারিবারিক হিংসা-বিরোধী মাস শেষ হয়নি। আমরা অদৃশ্য দেওয়ালে ‘আমিও আছি’ (#metoo) বলে ক্ষান্ত হব? না কি আর একটু এগিয়ে আসার সাহস দেখাব? এটা বোঝাতে যে, মায়েরা শুধু দশভুজা নন, দশপ্রহরণধারিণী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy