Advertisement
E-Paper

একলা মা’কে সমাজ দূরেই রেখেছে

আইন আদালত ক্রমশ ‘সিঙ্গল মাদার’-এর অধিকার স্বীকার করছে। কিন্তু সমাজ, মানে আশেপাশের মানুষ, মন থেকে সেই অধিকার আজও মেনে নিতে পারেনি।আইন আদালত ক্রমশ ‘সিঙ্গল মাদার’-এর অধিকার স্বীকার করছে। কিন্তু সমাজ, মানে আশেপাশের মানুষ, মন থেকে সেই অধিকার আজও মেনে নিতে পারেনি।

মৌ ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০৩

কিছু দিন আগের কথা। পাসপোর্ট বানাতে গিয়ে একটি তরুণী তাঁর বাবার নাম দিতে অস্বীকার করেন। যে বাবা কোনও দিন সঙ্গে থাকেননি, তাঁর নাম পাসপোর্টে থাকবে কেন? যে মা বড় করেছেন, তাঁর নামই কেন যথেষ্ট নয়? পাসপোর্ট অফিস রাজি না হতে তরুণী ও তাঁর মা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। রায় বেরোয়, কেবল মায়ের নামে সন্তান পাসপোর্ট পেতে পারে। গত বছর সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, অবিবাহিত মা সন্তানের একমাত্র অভিভাবক হতে পারে। সরকারি নিয়মে এখন আধার কার্ড, ভোটার কার্ডে বাবার নাম না দিলেও সমস্যা হয় না।

তবে একক মাতৃত্বের এমন সম্মান তো আইনের চোখে। সমাজ কী চোখে দেখে একলা মাকে?

‘সিঙ্গল মাদার’ শুনলেই এখনও লোকে প্রশ্ন করে, ‘মানে কী’? অর্থাৎ মা ডিভোর্সি না বিধবা, তা বুঝতে অনেকের সময় লেগে যায়। এখানে এখনও মেয়েরা স্বামীর পরিচয়ে বাঁচে। সমাজে ‘ডিভোর্স’ কথাটা বলতে অনেকেই দ্বিধা বোধ করেন। স্বামী কোথায় থাকে, জিজ্ঞাসা করলে তাই অনেক মেয়ে ‘বাইরে থাকেন’ বলে কাটিয়ে যান। পরিবার থেকে ডিভোর্সি মেয়েটিকে শেখানো হয়, এখুনি আত্মীয়-স্বজনকে ডিভোর্সের কথা না জানাতে। কিন্তু সে কথা এড়িয়ে ভুল ধারণা দেওয়া একটা ডিভোর্সি মেয়ের কাছে যে কতটা ঘৃণার, তা বোধহয় একমাত্র ওই মেয়েটিই বোঝে। যে সম্পর্ক চুকে গেছে, তার পরিচয়ে বাঁচতে হবে কেন? বাপের বাড়িতে কোনও আলোচনা হলে মেয়েটি একটু জোর গলায় কথা বললে সবাই চুপ করিয়ে দেয়। পাছে পাশের বাড়ির লোক শুনে ফেলে। জেনে যায়, মেয়ে এখনও বাপের বাড়িতেই থাকে। কী আশ্চর্য ভাবুন, নিজের বাড়িতে জোরে কথা বলাটাও সমস্যা। শুধু মেয়ের ডিভোর্সের কথা লুকিয়ে রাখার জন্য এত কিছু। বাড়িতে খোলামেলা কথা বলার অধিকারও হারায় মেয়েটি।

একলা মায়ের সন্তানকেও প্রথমে বাবার কথাই জিজ্ঞাসা করা হয়। বাড়িতে কোনও পুরুষ বন্ধু বা সহকর্মী এলেও বিপদ। ছোট্ট শিশুটিকে ডেকে পাড়ার লোক পাছে যদি কিছু জিজ্ঞাসা করে? সে কারণে ছেলে বন্ধুর বাড়িতে না আসাই ভাল, তা পরিবারের অন্যরা হাবভাবেই বুঝিয়ে দেন। আবার অনেকে মেয়েকে ডেকে আলাদা করে জিজ্ঞাসা করে, ‘‘তোর নতুন বাবা এসেছিল রে?’’ ওই দুধের শিশুর তো ‘বাবা’ সম্পর্কে কোনও জ্ঞানই নেই। সে তো জানেই না ‘বাবা’ কাকে বলে। সে শুধু মায়ের পরিচয়ে বাঁচতে শিখেছে। আদালত তা বোঝে, পরিবারকে বোঝাবে কে?

ডিভোর্স কথাটা বলার মধ্যে কোথাও একটা লজ্জাও থাকে। কীসের যেন ভয়। সব সময়ে একটা ঢাক ঢাক গুড় গুড় ব্যাপার। কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে ডিভোর্সি মেয়েকে না নিয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করেন অনেকে। কেউ কেউ মেয়েটিকে শাঁখা সিঁদুর পরিয়ে নিয়ে যান, এমনও দেখেছি।

একলা মা সিঁদুর ছাড়া রাস্তায় বেরোলে লোকে ‘সিঁদুর পরিস না কেন’ জিজ্ঞাসা করে। কপালের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘‘তোর বর কোথাও যেন থাকে রে?’’একটু সেজেগুজে অফিস গেলেই বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। আদৌ অফিস যাচ্ছি কিনা, সে-ও শুনতে হয়। সেজেগুজে বাড়ির থেকে বেরোলে পাড়ার ঠাকুমা-কাকিমারা মন্দ বলবে। বাড়ি থেকে অত সাজগোজ করে বেরোনোর প্রয়োজন নেই বলে থেকে থেকেই মনে করিয়ে দেন বাড়ির লোকজনই।

মেয়েকে স্কুলে ভর্তির জন্য স্কুলে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছি। সব শুনে সিস্টার বললেন, বাচ্চাকে কে দেখেন বাড়িতে? জিজ্ঞাসা করা হয় শিশুটির পদবি নিয়েও। বলা হয়, দ্বিতীয় বিয়ে করলে আপনার স্বামী শিশুটিকে দত্তক নেবেন। তখন পদবি বদলাতে হবে কিন্তু। চাকরি করি শুনে পরের প্রশ্ন, পারবেন তো এই স্কুলে পড়াতে? একা একা নিজের সন্তানকে সামলাতে পারবেন তো? কী ভাবে সময় দেবেন? কতটা দেবেন? সে দিন বলতে পারিনি, আরে মেয়েকে বেশি সময় দিতে গেলে তো চাকরিবাকরি ছাড়তে হবে। আর তা হলে এতগুলো টাকা খরচ করে মেয়েকে আপনার স্কুলে পড়াব কী করে?

বুঝতে পারছিলাম, সিঙ্গল মাদার বলে তাঁরা সে দিন দ্বিধা করেছিলেন, এত টাকা খরচ করে পড়াতে পারব কিনা মেয়েকে। অথচ অন্য শিশুদের বাবা-মায়ের মতো সিঙ্গল মাদারকেও তো ইনকাম সার্টিফিকেট দিতে হয়। তার পরেও এত প্রশ্ন!

সিঙ্গল মাদার মানেই ওয়ার্কিং ওম্যান, এটা মোটামুটি ধরে নেওয়াই যায়। সে ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের প্রতি টান কম হবে কি না, তাই নিয়ে উদ্বেগ দেখান অনেকে। একলা মা সন্তানকে সময় দিতে চান না বলেই বাইরে চাকরি করতে যান— এমন উদ্ভট ধারণাও দেখেছি আছে অনেকের। সন্তানের প্রতি একলা মায়ের ভালবাসার পরীক্ষা নিতে অতি-তৎপর আশেপাশের লোকজন। বাড়ির গেট থেকে বেরিয়ে তাড়াহুড়ো করে অফিস যাচ্ছি, সে সময়ে কেউ বলে উঠলেন, ‘‘মেয়েকে একটু আদর করে দিয়ে যা।’’ অথবা উড়ে এল প্রশ্ন, ‘‘মেয়ের সঙ্গে দেখা করেছিস?’’ যেন সে সময় আদর করে বেরোনো মানেই আমি আমার সন্তানকে ভালবাসি!

সিঙ্গল মাদারদের লোকে একটু বেশি সাহসী মনে করে ফেলেন, এটাও দেখেছি। মনে করেন, একা যখন দায়িত্ব নিয়েছে সন্তান মানুষ করার, তা হলে হয় তো মেয়েটি সবই পারে। তাই তো রাত সাড়ে দশটার ডাউন লোকালের ফাঁকা ট্রেনে মেয়েটিকে একা ছেড়ে দিতেও দ্বিধা বোধ করেন না। এঁদেরই কেউ কেউ হয়তো একদিন মেয়েটিকে বুঝিয়েছিলেন, রাতে মেয়েরা নিরাপদ নয়। তার সঙ্গেও যে আর পাঁচটা মেয়ের মতোই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, সে কথাটা তখন অনেকের আর মাথায় থাকে না। সিঙ্গল মাদার মানেই যেন স্বাভাবিক ভাবেই সুপারওম্যান। ডিভোর্স হওয়ার পর পর অনেকে ফোন করে বলেন, ‘‘চিন্তা নেই, আমরা আছি পাশে।’’ শেষে দেখা যায়, সন্তানের অসুখ থেকে নিজের মন খারাপ, সব একলা মা একাই সামলাচ্ছে।

বিধবাদের জন্য যদি বা কিছুটা সহানুভূতি থাকে, ‘সিঙ্গল মাদার’ শুনলেই শুরু হয়ে যায় গুজব। ‘সত্যি একা তো? না কি বাইরে কোনও বিশেষ বন্ধু-টন্ধু আছে।’ আর কারও সঙ্গে ওঠাবসা করতে দেখলে তো আর এক কেলেঙ্কারি। কফির টেবিলে কোনও পুরুষের মুখোমুখি বসার দৃশ্যও আশেপাশের লোকের কল্পনার জগতে পৌঁছে যায় শোওয়ার ঘর পর্যন্ত। এমন রসালো কানাঘুষোর কিছু কিছু যে সিঙ্গল মাদারটির কানে আসে না তা নয়। সব শুনেও মাথা ঠান্ডা রাখাই তাঁর লড়াই।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত যার পাশে আছে, সেই একলা মাকে আশেপাশের মানুষ একটু দূরে ঠেলে রেখে দেয়।

Single Mother Mou Ghosh Not Generous
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy