সমাপতন বলা মুশকিল। আবার ইচ্ছাকৃত সময় নির্বাচন বলাটাও হয়তো বাড়াবাড়ি। ২৬ নভেম্বর অর্থাৎ মুম্বই-এর তাজ হোটেল সন্ত্রাসের নবম বর্ষপূর্তির ঠিক আগে পাকিস্তানে মুম্বই-সন্ত্রাসের মূল অভিযুক্ত সন্ত্রাসবাদী ‘গুরু’ হাফিজ সইদকে মুক্তিদান একটি ধাঁধা হইয়া বসিল। গত মাস হইতেই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে সইদের বিরুদ্ধে আনীত সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠাইয়া লইয়াছে। কেবল হাফিজ সইদ নহে, তাহার নিজের হাতে গড়া জঙ্গি দল জামাত-উদ-দাওয়ার বিরুদ্ধেও জঙ্গিত্বের সাক্ষ্যপ্রমাণ নাকি মিলে নাই। এমতাবস্থায় তাহাকে আটক রাখিবার আইনি ভিত্তি নাই, এই মর্মে আবেদন জমা পড়িয়াছিল লাহৌর হাই কোর্টে। আদালত তাহা মানিয়া লইয়াছে। কাহিনিটি প্রত্যাশিত বলিউডি ছাঁদে গ্রথিত। একটিই কথা মনে রাখা দরকার। হাফিজ সইদের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ জঙ্গি ঘটনার প্রমাণ থাকুক না থাকুক, সে রাষ্ট্রপুঞ্জ চিহ্নিত ‘সন্ত্রাসবাদী’, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই সইদ-সংক্রান্ত যে কোনও অভিযোগ আনিলে আনয়নকারীকে ১০ মিলিয়ন পুরস্কার দিবার কথা ঘোষণা করিয়াছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি আদালত ও পাকিস্তানি সরকার এত বড় ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে লইল, আন্তর্জাতিক মহলে ইহা যথেষ্টই বিস্ময়জনক ঘটনা। মুক্তি পাওয়ামাত্র হাফিজ যে ভাবে কাশ্মীরকে ভারত হইতে কাড়িয়া আনিবার লক্ষ্যে আবার নূতন করিয়া যুদ্ধ-দামামা বাজাইয়া দিল, তাহাও উদ্বেগজনক বইকি।
এই ধরনের প্রকাশ্য ভারতবিরোধী দামামা বাজানোর পিছনে অবশ্য সাধারণত সত্যকারের যুদ্ধ-পরিকল্পনার অপেক্ষা এক ধরনের আত্মপ্রচারের খেলাই থাকে। কাশ্মীর লইয়া পাকিস্তানে দামামা বাজাইবার রাজনৈতিক তাত্পর্য তাই বুঝিতে অসুবিধা হয় না। ইহাই সে দেশে রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার প্রথম ধাপ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সহিত গা-ঘেঁষাঘেঁষির অপরাধে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ‘সরিতে হইয়াছে’, এই ঘোষণাও সেই একই জনপ্রিয়তা কাড়িবার পন্থা। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হইয়া ওঠে, যদি মনে রাখা যায় যে হাফিজ সইদের দল জামাত-উদ-দাওয়া বেশ কিছু কাল ধরিয়া পাকিস্তানের মূলস্রোতের রাজনীতিতে প্রবেশ করিবার চেষ্টায় আছে। মাত্র দুই মাস আগে, সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন এই চেষ্টা প্রতিহত করিয়াছে— মিলি মুসলিম লিগ পার্টি নামক যে সম্মুখ-সংগঠনের মাধ্যমে জেইউডি রাজনীতিতে পদসঞ্চার করিতে ইচ্ছুক, তাহার আবেদন নাকচ করিয়া দিয়াছে। কিন্তু এই ধরনের বাধা তো প্রচেষ্টার প্রত্যাশিত অঙ্গ মাত্র। জেইউডি জানে, তাহাকে স্বীকৃতি দিবার পক্ষে সওয়াল করিতে প্রস্তুত, পাকিস্তানে এমন রাজনৈতিক দলও কম নাই!
সুতরাং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কোনও ভাবে সন্ত্রাসী নাটের গুরুকে আটকাইতে পারিবে, এমন আশা বাতুলতা। আন্তর্জাতিক চাপ দিয়া এই কাজ হয় কি না, হইলে কী পদ্ধতিতে হইতে পারে, এইগুলিই আপাতত ভাবিবার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতিমধ্যেই অত্যন্ত কড়া বার্তা পাঠাইয়াছেন। পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান যে কতটাই অসার ও অর্থহীন, তাহা এই একটি কাজেই প্রমাণিত— এই কথা বলিয়া ট্রাম্প পাকিস্তানের উপর চাপ বাড়াইতেছেন, হুমকি দিতেছেন, সন্ত্রাসের ঘাঁটি ভাঙিবার চেষ্টায় আছেন। কিন্তু রাখে চিন মারে কে। আপাতত মার্কিন হুমকি-ভর্ৎসনা সবই কেমন যেন নিস্তেজ শুনাইতেছে। এই মুহূর্তে মার্কিন প্রেসিডেন্টের গর্জনও যে ভারতের অর্থমন্ত্রীর তর্জনের মতো ধারহীন শুনাইতেছে, তাহার পিছনে সেই বেজিংয়েরই অবদান। ইসলামাবাদের প্রতি চিনের অভয়-আশীর্বাদ আজ দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে পাকিস্তান-বিরোধীদের দ্রুত অনুল্লেখযোগ্য করিয়া দিতেছে। হাফিজ সইদের মুক্তি অপেক্ষা ইহা ভারতের পক্ষে আরও বড় উদ্বেগের বিষয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy