আসমা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা করাচিতে। পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশনের সভানেত্রী আসমা জাহাঙ্গীর একটি মানবাধিকার কনফারেন্সে যোগ দিতে আমাকে এবং ডক্টর শিশিরকুমার বসুকে করাচিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমরা এই আমন্ত্রণে পুলকিত হয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে যাবেন সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার। কুলদীপ ছাড়াও আমাদের সঙ্গী ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের এক মহিলা আইনজীবী। তিনি এরোপ্লেনে ওঠা-নামার সময় সর্বক্ষণ শিশির কুমারের হাত-লাগেজ বহন করেছিলেন। আমাদের করাচি সম্মেলনে যোগ দেওয়া শিশিরের আকস্মিক অসুস্থতার কারণে প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। শেষে ডাক্তার বললেন, যেতে পারেন, কিন্তু লাগেজ বহন করা চলবে না।
করাচির পার্ল কন্টিনেন্টাল হোটেলে আসমা আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। ছোটখাটো মিষ্টি চেহারার মহিলা। তিনি যে এত বড় সংগ্রামী নেত্রী, চেহারা দেখে বুঝতে পারা কঠিন। আসমা প্রথমেই বললেন, হোটেলের বাইরে একেবারেই যাবেন না, করাচিতে পথে-ঘাটে তখন তুমুল গোলমাল চলছে। হোটেলেরই বড় হলঘরে সম্মেলন। উদ্বোধন করবেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। সেই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আসমা জাহাঙ্গীরের ভাষণ শুনে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম। দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পাশে বসিয়ে সেই সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে তীব্র ভাষায় সে কী সমালোচনা! সাহস দেখে আমি হতবাক। প্রথম সারিতে নিজের আসন থেকে আমি আড়চোখে প্রধানমন্ত্রী বেনজিরকে দেখছিলাম। তিনি মোটের ওপর স্মিত মুখে বসেছিলেন। ঘন ঘন দৃষ্টিপাত করছি বলেই কি না জানি না, তিনিও আমার দিকেই দেখছিলেন। উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর স্টেজ থেকে গটমট করে নেমে এসে তিনি আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে ফেললেন। হয়তো তিনি কৌতূহলী হয়েছিলেন যে, দর্শক আসনে এক মহিলা বসে আছেন, যার পরনে বাংলার কাঁথা শাড়ি আর কপালে সিঁদুর।
একটি অল্পবয়সি পাকিস্তানি মেয়েকে আসমা আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এ তোমাদের দেখাশোনা করবে। মেয়েটি আমেরিকাতে কলেজে পড়ে, ছুটিতে দেশে এসে আসমার অনুপ্রেরণায় হিউম্যান রাইটস কনফারেন্সে কাজ করছে। মেয়েটি বলেছিল, আমেরিকার কলেজে তার প্রাণের বন্ধু ছিল কলকাতার বাঙালি মেয়ে, সে ব্রাহ্মণ। বাঙালি মেয়েটি রমজানের সময় বন্ধুর সঙ্গে এক মাস রোজা রেখেছিল। কিন্তু তাকে যখন ইদ কমিটিতে নেওয়ার কথা হল, প্রবল আপত্তিতে নেওয়া সম্ভব হল না। এর পর এল হোলি উৎসব। ভারতীয় ছাত্রীরা আয়োজনে ব্যস্ত। একটাই সমস্যা, তারা কেউ হালুয়া রাঁধতে জানে না। পাকিস্তানি মেয়েটি হালুয়া রেঁধে দিয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশে ভোগ নিবেদন করে সে ধন্য বোধ করেছিল। আসমার সূত্রে নানা ধরনের লোকজনের সঙ্গে পরিচয় হল। বিশেষ করে মনে পড়ছে, সুরাবর্দির ভগিনী শায়েস্তা সুরাবর্দির কথা। তিনি কেবলই কলকাতার খবর জানতে চান। আমাদের তাঁর করাচির বাড়িতে ধরে নিয়ে গেলেন, ছবি দেখালেন— কলকাতায় তাঁদের সুরাবর্দি অ্যাভিনিউয়ের বাড়ির সামনে নেতাজি ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এক রাতে করাচির পথঘাট কিছু শান্ত থাকাতে আসমা আমাদের এক জনের গাড়িতে তুলে দিয়ে বললেন, রাতের অন্ধকারেই করাচি শহর একটু দেখে নিন।
এই সম্মেলনের পর থেকে আসমা জাহাঙ্গীর ও পাকিস্তান হিউম্যান রাইটস কমিশনের সঙ্গে নেতাজি ভবনের যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল। লাহৌরে ও কলকাতায় দেখাসাক্ষাৎ হত। এক বার অন্য একটি প্রতিনিধিদলে লাহৌরে ছিলাম। কাজের ফাঁকে আমি ও শিশির বসু লাহৌরের পাকিস্তান হিউম্যান রাইটস কমিশনের অফিসে চলে গেলাম। লাহৌরের অফিসটির ভারী সুন্দর স্থাপত্য। আসমা জাহাঙ্গীর, আই এ রেহমান ও অন্য সদস্যদের সঙ্গে অনেকক্ষণ আলোচনা হল। আমাদের দেশে, কেন্দ্রে অথবা রাজ্যে মানবাধিকার কমিশন সরকার গঠন করে দেয়, তাদের পক্ষে সাহসের সঙ্গে স্বাধীন ভাবে কাজ করা কঠিন। পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশন একটি স্বাধীন স্বয়ংশাসিত সংস্থা, তারা সরকারের সমালোচনা করতে পরোয়া করে না। কথাটা বলা সহজ, কিন্তু আসমা জাহাঙ্গীরের মতো অসমসাহসী মহিলা ছিলেন বলেই পাকিস্তানের মিলিটারির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছিল। সে-দিন কমিশনের অফিস থেকে বেরিয়ে আমরা আজাদ হিন্দ ফৌজের জেনারেল মহম্মদ জামান কিয়ানির পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমরা লাহৌরে এলে সাধারণত জামানের মেয়ে-জামাই জাহিদা ও ফরিদের সঙ্গে থাকতাম, এ-বার হোটেলে ছিলাম। আমরা হোটেলে ফিরে আসার পর পাকিস্তানের আইএসআই গোয়ান্দা দল জাহিদার বাড়িতে হানা দিয়ে আমরা কেন সেখানে এসেছিলাম ইত্যাদি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। বুঝতে পারা গেল, আমাদের কমিশনে অতক্ষণ আলোচনা করা ও তার পর ওদের বাড়ি যাওয়া তাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছে।
আমি পার্লামেন্টের বিদেশ মন্ত্রক কমিটির চেয়ারপার্সন থাকার সময়ে সরকার থেকে প্রথা অনুযায়ী নানা বিষয়ে মতামত চাওয়া হত। এক বার তাঁরা জানতে চাইলেন, এ বছরের গাঁধী শান্তি পুরস্কার কাকে দেওয়া যেতে পারে। অনেক বিদেশি এই সম্মান পেয়েছেন। আমি লিখিত ভাবে জানিয়েছিলাম আসমা জাহাঙ্গীরকে অবশ্যই বিবেচনা করা উচিত। পাকিস্তানের প্রকৃত শাসক, সে দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি যে ভাবে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছেন তাতে এই সম্মান তাঁর প্রাপ্য। আমার মনে হয়েছিল ভারতের দিক থেকেও এটি ও-দেশের প্রতি বিশেষ বার্তাবহ হবে। বলাই বাহুল্য, আমার মত গ্রাহ্য হয়নি।
আসমা দিল্লিতে বা কলকাতায় এলেই যোগাযোগ করতেন। এক বার কলকাতায় ভারতীয় সালোয়ার-কামিজ কিনতে চাইলেন, আমার পরামর্শ মতো রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের দোকান থেকে কিনেও নিলেন। কাজের সূত্রে অনেক পাকিস্তানি মহিলা এমপি ও রাজনীতিক আমার পরিচিত। লক্ষ করেছি, তাঁরা সকলেই বেশ ফ্যাশনদুরস্ত। তুলনায় আসমার পোশাক পরিচ্ছদ, জীবনযাপন ছিল খুব সহজ, সাধারণ। এক বার আসমাকে নেতাজি ভবনে শরৎচন্দ্র বসু স্মারক বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালাম। সালটা ছিল ২০০৪। আসমার বিষয় ছিল ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব’। আসমা বরাবরই ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা বলেছে এবং তার জন্য নিজের দেশে সমালোচিত হয়েছে। তাঁর বক্তৃতায় নেতাজি ভবনে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। কলকাতার বিশিষ্ট মানুষজন ও বিদেশি কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন। ভিড় সামলাতে হলের বাইরে চেয়ার এবং স্ক্রিনের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। আসমার বক্তৃতার পরে কীভাবে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সুসম্পর্ক গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব খুবই জমে উঠেছিল।
আজ ভারত-পাক সম্পর্ক এক বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। নিত্যদিন সীমান্তে হাঙ্গামা ও রক্তপাত চলছে। এই সময়ে আসমা জাহাঙ্গীরের মতো মুক্তমনা, গণতন্ত্রপ্রেমী, মানবতা-দরদি মানুষের একান্ত প্রয়োজন। আসমার অকালপ্রয়াণ ভারতীয় উপমহাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তার পথ আরও অনেক দুর্গম করে দিল।
ভূতপূর্ব সদস্য, লোকসভা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy