Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Smuggling

কাঁটা অনেক গভীরে গেঁথে, তুলে ফেলতে হবে এখনই

পাচার করতে গিয়ে সীমান্তে ধরা পড়ছেন এমন অনেকে, যাঁদের নামে আগে কখনও এমন কোনও অভিযোগ ওঠেনি। বোঝা যাচ্ছে, সীমান্তের কিছু এলাকায় সহজ অর্থের লোভে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশ সুস্থ করে তুলতে প্রশাসনকে পথে নামতে হবে। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ানেরা ভাবছেন, পাচারের একটি নতুন প্রবণতা শুরু হয়েছে। মুর্শিদাবাদে সীমান্ত পাচার নতুন কোনও ঘটনা নয়।

বিমান হাজরা
শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০২০ ০৫:১৫
Share: Save:

মহিলার বয়স ৪৮ বছর। বাড়ি জলঙ্গির গোলাগাডিতে। নেহাতই ঘরের বৌ। স্বামীর কাজ নেই। তিন ছেলেমেয়ে। এক ছেলে পরিযায়ী শ্রমিক। বাড়ি ফিরেছে দিন কুড়ি আগে। খালি হাত। কোনও এক বন্ধুর পরামর্শে সেই মহিলা ভরা বিকেলে বেরিয়েছিলেন সীমান্তের পথে। কিন্তু বিএসএফের কড়া পাহারায় সীমান্ত পথে চলতে অনভ্যস্ত মহিলা শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যান। তাঁর কাছে তল্লাশি চালিয়ে মেলে মাত্র ১৫ বোতল ফেনসিডিল, কয়েক প্যাকেট ডিটারজেন্ট পাউডার, তেলের শিশি। সামান্য সঞ্চয় থেকে স্থানীয় বাজার থেকে সে সব কিনে সীমান্তে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, যাতে পাচার করে দু’টো পয়সা মেলে! ধরা পড়ার পরে বিএসএফের কাছেও জানিয়েছিলেন তার সংসারের অভাবের কথা। কিন্তু ছাড় মেলেনি। আপাতত জেল হেফাজতে ওই মহিলা। মাদক পাচারের অভিযোগে।

তিিন একা নন। বামনাবাদ চরে বিএসএফ জওয়ানদের নজরে পড়ে রাতের আঁধারে সীমান্তের চরের পথে একটি ব্যাগ নিয়ে এগুচ্ছেন এক যুবক। তাঁকে তাড়া করে জওয়ানেরা। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে হাতের ব্যাগ ফেলে পালিয়ে যান তিনি। তখনও ব্যাগ খুলে মেলে মাত্র ৩৯ বোতল ফেনসিডিল ও একটি প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া এক কিলো গাঁজা। যুবকটিকে ধরা যায়নি। তবে সামান্য এক কিলো গাঁজা ও ৩৯ বোতল ফেনসিডিল যে অভ্যস্ত কোনও পাচারকারির কাজ নয়, তা মানছেন বিএসএফ জওয়ানেরা। তাঁরাও অবাক পরপর এই ঘটনায়।

জঙ্গিপুরের বাহুরা ঘাট আউট পোস্টের বটতলা চরে প্রহরারত জওয়ানদের নজরে পড়ে প্রচণ্ড গতিতে পিরোজপুর চরের দিকে যাওয়া একটি মোটর বাইক। সন্দেহ হওয়ায় থামানো হয় বাইকটিকে। বিএসএফ জানায়, বাইক চালক বছর চল্লিশের চেনা যুবককে তল্লাশি করে তাঁর কাছ থেকে ছোট ছোট প্যাকেটে ১৯০০ মাদক ট্যাবলেট পাওয়া যায়। বাইক চালকের বাড়ি পিরোজপুর চর গ্রামে। পেশায় রাজমিস্ত্রি হলেও এ বারে ভিন্ রাজ্যে কাজে যাননি। এখানেও কাজ বন্ধ।

বহরপুরের দিঘলকান্দি আউটপোস্টের কাছে প্রহরারত জওয়ানদের নজরে পড়ে জনা তিনেক দুষ্কৃতী বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে যাচ্ছে কিছু বয়ে নিয়ে। বিএসএফ জওয়ানরা তাড়া করলে গা ঢাকা দেয় পাচারকারিরা। মেলে ৫ কিলো গাঁজা ।

এই সব ঘটনা দেখে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ানেরা ভাবছেন, পাচারের একটি নতুন প্রবণতা শুরু হয়েছে। মুর্শিদাবাদে সীমান্ত পাচার নতুন কোনও ঘটনা নয়। তবে এতদিন ছিল গরু পাচার, জাল নোট পাচারের রমরমা। তা প্রায় বন্ধ লকডাউনে যাতায়াতে নিয়ন্ত্রণ জারি হওয়ায়। এখন তার জায়গা নিয়েছে মাদক। মূলত ফেনসিডিল, গাঁজা, মাদক ট্যাবলেট। পরিমাণেও তা খুব বেশি নয়।

কিন্তু সব থেকে বড় বিপদের কথা হল, বিএসএফের সন্দেহ, এই সব পাচারে বড় কোনও চাঁই জড়িত নয়। সাধারণ স্থানীয় মানুষেরা এই সব সীমান্ত পাচারে জড়িয়ে পড়ছেন অর্থাভাবের কারণে।

স্বভাবতই কিছুটা উদ্বেগ বেড়েছে বিএসএফের মধ্যে। গত দু’মাসে বিএসএফের হাতে এই ধরনের কিছু পাচারকারি ধরাও পড়েছে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন সীমান্ত লাগোয়া চর এলাকায়। উদ্ধার হয়েছে গাঁজা ও মাদক, কাশির সিরাপ ফেনসিডিল। কম পরিমাণে দু’এক জন মিলে যে ভাবে এই সব মাদক পাচারের চেষ্টা হয়েছে, তা যে কোনও বড় মাথার কাজ নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত বিএসএফ। ধৃতদের নামে অতীতের কোনও মাদক পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগও ওঠেনি। তা ছাড়া, রাতে এ ভাবে সামান্য কিছু মাদক নিয়ে বিএসএফের কড়া পাহারা আছে জেনেও সীমান্ত পেরোবার ঝুঁকি কোনও পেশাদার পাচারকারি নেবে না বলেই মনে করছে বিএসএফ।

বিএসএফের এক কর্তা জানান, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধরা পড়েছে মাদক। তার পরিমাণও অনেকটাই কম। এরা যে সকলেই পরিচিত মাদক পাচারকারি তাও নয়। কিছু মানুষ স্থানীয় এলাকা থেকে এগুলি নিয়ে বাংলাদেশে পাচারের চেষ্টা করছে। কারণ বাংলাদেশে ফেনসিডিল সহ যাবতীয় মাদকের ভাল দাম রয়েছে। এর জন্য বাংলাদেশ সীমান্ত পেরোবারও দরকার নেই। এক শ্রেণির দালাল রয়েছে, বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায়। তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েই ফিরে আসা।

বিএসএফ কর্তা বলেন, “এখন যারা ধরা পড়ছে, তারা নেহাতই আনাড়ি। তাদের পক্ষে জাল টাকা বা গরু পাচার করা সম্ভব নয়। কারণ তা সংগ্রহ করে পাচারের রাস্তা এরা সে ভাবে জানে না। এরা কেউই জাত পাচারকারী নয়। তা ছাড়া গরু ও জাল টাকা স্থানীয় বাজারে পাওয়া যায় না। কাজেই সামান্য কিছু রুজির জন্য মাদকটাকেই বেছে নিয়েছে তারা। পাচারের অভিজ্ঞতা না থাকায় এবং বিএসএফ জওয়ানদের কড়া নজরদারিতে তারা ধরা পড়ছে।”

রাজ্য পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ডিএসপি কামাখ্যাচরণ মন্ডল বলছেন, “কাজ হারালে গরিব মানুষ তো আয়ের বিকল্প পথ খুঁজবেই। সেখানে সহজে টাকা মিলছে পাচার করলে। সে পথে নিয়ে যাওয়ার লোকেরও অভাব নেই।’’ তিনি বলছেন, ‘‘একশো দিনের কাজে কম মজুরিতে কাজ করার যে কায়িক পরিশ্রম, তা করতে আগ্রহ নেই তাদের। কিন্তু, নিজেরা পাচার না করলেও সীমান্তপথে পাচার তারা অনেকেই দেখেছে। পাচারে বহু মানুষ রাতারাতি বিত্তশালী হয়ে উঠেছে সীমান্ত এলাকায়। তাই এই পথটাকেই সহজ পথ মনে করে বেছে নিচ্ছে কেউ কেউ।’’ অরঙ্গাবাদ কলেজের শিক্ষক সাধনকুমার দাসের বাড়ি সীমান্ত লাগোয়া এক গ্রামে। তিনি বলছেন , “বড় পাচার বন্ধ । কিন্তু এখনকার ছোট ছোট পাচারের ঘটনা আরও উদ্বেগের। বুঝতে অসুবিধে নেই, নেহাতই আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণেই এই সব প্রবণতা।” কী করে রোধ করা যাবে এই প্রবণতা? মুর্শিদাবাদের অর্থনীতির প্রবীণ কলেজ শিক্ষক কিশোর রায়চৌধুরীর মতে, “শুধু ধরপাকড় করে জেলে পাঠানোই এই সমস্যার সমাধান নয়। গভীর থেকে কাঁটা তুলতে হবে। এর মোকাবিলায় পঞ্চায়েতগুলিকে কাজে লাগাতে হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Smuggling BSF Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE