মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীকে আমার কিছু জানানোর আছে। আমি এক ভয়ংকর আতঙ্কে ভুগছি। মরশুমি আতঙ্ক বলা যায়। আজকাল ফি-বছরই বর্ষার শুরু থেকে শীত পড়া অবধি আতঙ্কটা ঘাড়ে চেপে বসে। প্রায় রাত্রে স্বপ্ন দেখি, আমি বা আমার কোনও প্রিয়জন হাসপাতালের বেডে, হাতে স্যালাইনের সূচ। আর পাশে রাখা মনিটরে তুর্কিনাচন নাচছে প্লেটলেটরা।
বড্ড ভয় পাচ্ছি। ঘরে আমার তিন বছরের মেয়ে। ওকে স্কুলে পাঠাতে সাহস পাচ্ছি না। স্কুলের এলাকায় ডেঙ্গি। বাড়িতেই বা লুকোব কোথায়? পাশের পাড়া কাঁপছে জ্বরে। সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে পাগলের মতো মশার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ি। সারা দিন বাড়িতে জ্বালিয়ে রাখি মশা তাড়ানোর জ্বালানি। বন্ধ রাখি সব জানলা-দরজা। পাশের রাজ্য থেকে নাকি মশা আসছে এ রাজ্যে, আর এ তো নিজের কিংবা পাশের পাড়া! সকালে মেয়েকে জবরদস্তি ন’টা অবধি শুইয়ে রাখতে চাই মশারির মধ্যে। তার পর ছোট্ট হাতে-পায়ে দেদার ঢালি অ্যান্টি-মশা ক্রিম, পিঠে প্যাচ লাগাই, জামায় স্প্রে করি। তীব্র গন্ধে নিজেরই প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ে। কিন্তু তাতেও নিশ্চিন্ত হতে পারি না। ওগুলোতেও নাকি একশো শতাংশ নিরাপত্তা নেই।
মেয়েটার বাহারি ফ্রক, কেতার হট প্যান্ট, কেপ্রি— সব আলমারিতে বন্দি। দোকানে গিয়ে খুঁজি পা-ঢাকা, হাত-ঢাকা জামা। অগস্ট-সেপ্টেম্বরের পচা গরমেও খোলামেলা কিছু পরানোর কথা ভাবতে পারি না। স্কুল থেকে ফিরলেই তন্ন তন্ন করে দেখি, কোথাও একটাও মশা কামড়ানোর লাল দাগ রয়েছে কি? ওকে নিয়ে অন্যের বাড়ি যাওয়া আপাতত বন্ধ। কে জানে সেখানে ঠিকঠাক মশা আটকানোর ব্যবস্থা আছে কি না! ফাঁকতালে সে পাড়ার এডিস যদি তেড়ে এসে কামড়ে দেয়! অবস্থা এমন, চেনা চৌহদ্দিতে কারও জ্বর হলেই শিউরে উঠি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চাই সঙ্গে সর্দি-কাশি আছে কি না। কাশতে কাশতে সে বেঁকে গেলেও খুব খুশি হই— যাক এ জ্বর সে জ্বর নয়।
শীত শুরুর আগে মরশুমি জ্বর তো ফি-বছরই হয়। সঙ্গে মাথায়, গায়ে-হাতে-পায়ে ব্যথাও থাকে। কোনও কোনও সময় অ্যালার্জির মতো র্যাশও। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, ঋতু বদলানোর সময় জ্বর-সর্দি-কাশির পর্ব পেরিয়ে শরীর তার নিজের সুরক্ষাবলয় নিজেই তৈরি করে নেয়। সেই জ্বরে স্কুল কামাই করে, বড়দের কিছু অতিরিক্ত নজরদারি পেয়ে ভারী খুশিও হয়েছি। কই, তাতে তো এমন মৃত্যুভয় কামড় বসাত না!
‘অযথা আতঙ্কিত’ না হওয়ার সরকারি অনুরোধও তা কমাতে পারছে কই! মাথার ভিতরে চিন্তাগুলো টিক টিক করেই চলেছে— ৪৮ ঘণ্টা জ্বর পেরোলেই রক্তপরীক্ষা করতে হবে, ডেঙ্গি ধরা পড়লে প্লেটলেটের দিকে কাঁটা হয়ে তাকিয়ে থাকতে হবে, এবং প্রয়োজনে পাগলের মতো হাসপাতালের দরজায় দৌড়ে বেড়াতে হবে!
হ্যাঁ, আমরা এখন জেনে গেছি, মহারাষ্ট্রে ৬৯৫, কেরল ১১১, অসমে ৮০ জন ডেঙ্গিতে মারা গিয়েছেন। সেখানে এখনও অবধি এ রাজ্যে মৃতের সংখ্যা মোটে ১৩। সংখ্যার এই বিরাট পার্থক্যে স্বস্তি আসারই কথা ছিল। আসেনি। কারণ অন্য রাজ্যে বেশি মানুষ মরলে এ রাজ্যে সরকারি ব্লাডব্যাংকে প্লেটলেটের জোগান উপচে পড়বে না, পুরকর্মীরা প্রচণ্ড তৎপর হয়ে তেল, কামান নিয়ে পথে নামবেন না, মশারাও কিছু কম কামড়াবে না। তা হলে আর শুকনো পরিসংখ্যান শুনে লাভ কী! তার চেয়ে যদি এই আশ্বাস মিলত— সরকারি হোক বা বেসরকারি, প্রত্যেক হাসপাতালে উপযুক্ত চিকিৎসা মিলবে, কেউ ‘সুস্থ’ হয়ে বাড়ি ফেরার পর মারা যাবেন না, ডেঙ্গি মোকাবিলার উপকরণগুলো কোনও কালোবাজারি ছাড়াই বাজারে পর্যাপ্ত মিলবে এবং সরকার থেকে ছড়ানো ব্লিচিং পাউডার মুরগি খুঁটে খাবে না, তা হলে খানিক দম নেওয়া যেত।
সমস্তটাই পাগলামি, না? খুব বাড়িয়ে ভাবছি? কিন্তু কী করব, সাউথ পয়েন্ট, চেতলা, লেক থানা আর উল্টোডাঙার অকালে চলে যাওয়া বাচ্চাগুলোর ছবি এমন চাবুক চালাল মনে, নিজেকে বড় বেসামাল লাগছে! এমনিতেই তো মায়েদের কত রকমের ভয়! বাচ্চা স্কুল যেতে শুরু করলে সেই ভয়ও পাল্লা দিয়ে বাড়ে। পুল কারের হেল্পার ঠিক মতো বাচ্চাকে স্কুলে নামাল কি না, গাড়িটার কলকবজা ঠিক আছে কি না, স্কুলে খেলতে গিয়ে কোনও দুর্ঘটনা ঘটল কি না, কেউ ওকে মারল কি না... এ সব নিয়ে চিন্তা মায়েদের রোজনামচায় ঢুকে গিয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে যদি ফি-বছর ছ’আট মাস ধরে মশা কামড়ানোর ভয় জোড়ে, তা হলে আমরা মায়েরা যাই কোথায়!
কলকাতা তো আর সত্যিই লন্ডন হবে না। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর অবধি বৃষ্টি চলবে, খানাখন্দ-প্লাস্টিক-ডাবের খোলে জলও জমবে, মশাও হবে। সে মশা কামড়াবেও। তা হলে কি সদ্যোজাত থেকে আশি-পঁচাশি— সবাইকে বছরের আধখানা মশারির ভিতরেই থাকতে হবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy