Advertisement
E-Paper

নিরাপত্তা নামক বিলাসিতা আজ আর সুদূর দ্বীপেও সম্ভব নয়

নিউজ়িল্যান্ডে রাতারাতি সেই উদ্বেগ ঘাঁটি গেড়ে বসল। পুলিশে পুলিশে ছেয়ে গেল সমস্ত ছোটবড় শহর। মাথার উপর টহল দিতে শুরু করল হেলিকপ্টার।

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৯ ০০:৫২
বিশ্বযোগ: নিউজ়িল্যান্ডের জঙ্গি হামলার পর বিশ্বময় শান্তির প্রার্থনা, আরও এক বার। কেপটাউন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৭ মার্চ। রয়টার্স

বিশ্বযোগ: নিউজ়িল্যান্ডের জঙ্গি হামলার পর বিশ্বময় শান্তির প্রার্থনা, আরও এক বার। কেপটাউন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৭ মার্চ। রয়টার্স

এই সোমবারের মতো সোমবার সে দেশে কেউ দেখেনি আগে। থমথমে, আড়ষ্ট হয়ে সপ্তাহের রুটিনে ফিরছে একটা গোটা দেশ। ইস্কুলে যাওয়ার আগে শিশুরাও জেনে গিয়েছে, কেমন করে ভয় পেতে হয়। গত শুক্রবারের ঘটনার পর নিউজ়িল্যান্ডের ইস্কুল কলেজ অফিস সব বন্ধ ছিল। কিন্তু কত ক্ষণ, কত দিন! কোনও না কোনও সময়ে তো স্বাভাবিকে ফিরতেই হবে। প্রতি মুহূর্তে ভয় শিরশিরিয়ে উঠবে, তবু ইস্কুলে কলেজে অফিসে যেতে হবে। মুহূর্তে সব আলো মুছে যেতে পারে জেনেও আলোর কথা ভাবতে হবে। একেই কি বলে প্রলয়? অ্যাপোক্যালিপস?

মনে হয় দ্বিতীয় শব্দটাই উপযুক্ত। বই-সিনেমা-কমিকস শব্দটা হরদম ব্যবহার করলেও ওর আসল মানেটা সকলের জানা নয়। অথচ অ্যাপোক্যালিপস-এর অর্থ ঠিক এই রকমই: এই বিরাট বিপুল ব্রহ্মাণ্ডে কত কী ঘটে যাচ্ছে, পৃথিবীর একটি কোনায় বসে তার কতটুকুই বা জানা সম্ভব, কিন্তু হঠাৎ সেই অজানা অচেনা বিপদ এসে হুড়মুড় করে মাথার ওপর ভেঙে পড়তে পারে, যে কোনও জায়গায় যে কোনও মুহূর্তে— এবং শেষ করে দিতে পারে সব। সম্প্রতি আমেরিকার গল্পলেখক ডেল বেলি যুক্তি দিয়েছেন অ্যাপোক্যালিপস-এর ভাবনাটা কেন এত জনপ্রিয়— কেননা এটা সত্যি! সত্যি বলেই তো আধুনিক বিশ্বে সব সময় এত উদ্বেগ। উদ্বেগে অস্থির হয়ে বাঁচা, কী হবে কী হতে পারে ভাবতে ভাবতে।

নিউজ়িল্যান্ডে রাতারাতি সেই উদ্বেগ ঘাঁটি গেড়ে বসল। পুলিশে পুলিশে ছেয়ে গেল সমস্ত ছোটবড় শহর। মাথার উপর টহল দিতে শুরু করল হেলিকপ্টার। ক্রাইস্টচার্চে তো বটেই, কাছাকাছি বড় শহর ডুনেডিন-এর বিমানবন্দরও বন্ধ হয়ে গেল নিরাপত্তার উদ্বেগে। ডাক্তার বন্ধু সে দেশ থেকে জানাল, হাসপাতালে হাসপাতালে এখন চব্বিশ ঘণ্টার ‘অ্যালার্ট’!

এর মধ্যেই দেখলাম নিউজ়িল্যান্ডের সরকারের ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইটে সে দেশের বিজ্ঞাপনেও নেমে এসেছে আত্মসংশয়। ওই ওয়েবসাইটে ওখানকার প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে লেখা হত ‘সেফটি’ বা নিরাপত্তার কথা। নিরাপত্তা ওদের গর্বের বস্তু। কেনই বা হবে না। গ্লোবাল পিস ইনডেক্সে এ দেশ গত চার বছর ধরে হয় দ্বিতীয় নয় চতুর্থ স্থানে রয়েছে (১৬৩ দেশের এই তালিকায় ভারত ১৩৬ নম্বরে)। ওয়েবসাইটের প্রথম লাইনেই লেখা থাকত, ‘‘নিরাপদ বোধ করাটা যখন বিশ্বের অনেক জায়গাতেই একটা বিলাসিতার পর্যায়ে চলে গিয়েছে, নিউজ়িল্যান্ডের অধিবাসীরা কিন্তু এই বোধেই অভ্যস্ত’’— ‘‘হোয়াইল ফিলিং সেফ ইজ় আ লাক্সারি ইন মেনি প্লেসেস, ইট’স ওয়ান দ্যাট নিউজ়িল্যান্ডার্স আর অ্যাকাস্টমড টু!’’ শুক্রবারের পর প্রথম লাইনটা পাল্টে যায়নি, কিন্তু ঠিক তার নীচেই এসে গিয়েছে একটি জরুরি দ্বিতীয় লাইন, ‘‘আমরা বলছি না যে অপরাধ এখানে ঘটে না, শুধু এটুকুই বলছি যে অন্য দেশের চেয়ে কম ঘটে।’’

এ তো শুধু নিজেকে নিয়ে, পরিবারকে নিয়ে উদ্বেগ নয়! দেশটাই যদি পাল্টে যায়, কতই না দিশেহারা হয়ে পড়ার কথা। রোজকার রুটিনে

সেটা মানিয়ে নেওয়া কি সোজা ব্যাপার। এই যে ‘দেশের প্রধান গর্ব নিরাপত্তা’, এ তো কোনও কথার কথা নয়। নিজের চোখেই দেখেছি এর সত্যতার পরিমাণ। মনে পড়ে, বিমানে সুটকেস আসেনি বলে চিন্তায় যখন আকুল, বিমানবন্দর ভরসা দিল, আজই পেয়ে যাবেন, কোনও চিন্তা নেই। এ দিকে ‘সাইটসিয়িং’-এ যাচ্ছি, হোটেলে কেউ থাকব না, সুটকেস ফিরলেই বা তবে কী হবে, ইত্যাদি।

উদ্বেগ একরাশের মধ্যে প্রসন্ন আশ্বাস: কোনও চিন্তা নেই। ভারাক্রান্ত মনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে ফিরতি পথে সন্ধের নিবে আসা আলোয় দূর থেকে দেখি— দ্বারে দণ্ডায়মান লাল সুটকেস! কেউ পাহারা দেয়নি, কিছু হারায়নি।

কিংবা, গাড়ি ভাড়া নিলাম রেন্টাল কোম্পানি থেকে, ফেরার দিন ট্রেনে ওঠার আগে কোম্পানিকে ফেরত দেওয়ার কথা, কিন্তু গাড়ি ফেরতের দিনটি রবিবার বলে সব বন্ধ, রেন্টাল অফিস বলল: কোনও চিন্তা নেই, স্টেশনে এসে গাড়ি পার্ক করে গাড়ির মাথায় চাবি রেখে দিয়ো, আমরা সোমবার এসে গাড়ি পেয়ে যাব। শুনে বাক্যিহারা হয়ে কোনও রকমে বললাম, গাড়ির মাথায় চাবি, কেউ যদি... ভেসে এল নিশ্চিন্ত আশ্বাসবাণী: কোনও চিন্তা নেই।

কোনও চিন্তা সত্যিই ছিল না। সেই স্টেশন ছেড়ে তিনশো মাইল দূরে বসে সোমবার খবর পেলাম, রেন্টাল অফিস পেয়ে গিয়েছে গাড়ি। আসলে আমাদের তো উদ্বেগ না-করা অভ্যেস নেই, তাই করেছি। ভেবেছি, সুটকেস চুরি হয়ে যাবে, অতগুলো জিনিস! ভেবেছি, গাড়ির চাবি-সহ গাড়িটাই চুরি হয়ে যাবে, বিদেশ বিভুঁইয়ে গাড়ির দাম মেটাতে হবে, অত দামি গাড়ি! না, নিউজ়িল্যান্ডবাসীরা আমাদের মতো না, তারা এ সব ভাবে না।

ভাবত না। গত শুক্রবার থেকে হয়তো পাল্টে গেল সব। নিরাপত্তা শব্দটাকে তারা দিনযাপনের একটুও জায়গা দিত না, কেননা নিরাপদ

থাকাটাই তাদের কাছে ছিল চাঁদতারাসূর্যের মতো স্বাভাবিক। নিরাপত্তা ব্যবস্থাই যেখানে আলাদা করে তৈরি হয়নি, সেখানে যদি হঠাৎ শহরের মাথায় হেলিকপ্টার বনবনিয়ে পাক দেয়, স্টেশনে-এয়ারপোর্টে সন্দেহের চোখে দেখা হয় সব যাত্রীকে, শহরের রাস্তায় নেমে আসে শয়ে শয়ে পুলিশ— সুটকেস বা গাড়ির চাবিও তো তা হলে অমন নিশ্চিন্তে আর পড়ে থাকতে পারবে না! মানুষগুলো মানিয়ে নিতে পারবে তো? উদ্বেগ করা অভ্যেস নেই ওদের, কী হবে ওদের!

এই এক দেশ যেখানে ভেড়ার সংখ্যা আজও মানুষের সংখ্যার চেয়ে দশ গুণ বেশি। এই এক দেশ যারা আজও চাষবাস গরুভেড়া-পালন থেকেই জাতীয় আয়ের বৃহদংশ আনতে চায়। এই এক দেশ যারা এখনও কারখানা বানাতে চায় না পরিবেশ দূষণের ভয়ে। ক্রাইস্টচার্চের হামলা বুঝিয়ে দিল, এমন দেশকেও সন্ত্রাস ও ত্রাসের বলয় থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা চলবে না আর। একেই কি বলে বিশ্বায়ন?

বিশ্বায়ন, নিশ্চয়ই। এখন বাড়িতে বসেই ইন্টারনেটে পছন্দের মতাদর্শে দীক্ষিত হওয়া যায়, মানুষ মারতে মারতে হেলমেট-লগ্ন ক্যামেরায় তোলা ভিডিয়োর লাইভ স্ট্রিমিং বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়া যায়, বিশ্বকে আপন হৃদয়ে যোগ করা এখন— জলভাত। কোনও প্রান্তই এখন আর প্রান্ত নয়। নিউজ়িল্যান্ড কেন, কোনও জলবেষ্টিত ভূখণ্ডই আজ আর ‘দ্বীপ’ নয়। ‘দ্বীপ’ শব্দটার মানেই গিয়েছে বদলে।

তবে কিনা, বিশ্বায়িত হয়ে ওঠার এখনও সবে প্রাথমিক পর্যায়। তাই ও দেশের প্রধানমন্ত্রী এখনও বহুসংস্কৃতির কথা সমাদর করে বলেন। এখনও সেখানে দেশের ১ শতাংশ মুসলিম অধিবাসী যাতে নিরাপত্তাবোধের অভাবে না ভোগেন সে জন্য অন্যান্যরা তৎপর হয়ে ওঠেন। এখনও সেখানে মসজিদে গণনিধন হয়েছে বলে অমুসলিমরা রাতারাতি এত পরিমাণ হালাল খাবার জোগাড় করে ফেলেন যাতে তা উদ্বৃত্ত হয়ে যায়। আমরা তো জানিই যে, এর একটা পরবর্তী পর্যায়ও আছে। যখন সংখ্যালঘুদের উপর সন্ত্রাস ঘটলেও প্রধানমন্ত্রীরা কিছু বলেন না। মুসলিমদের উপর আঘাত এলে প্রতিবেশীরা আন্তরিক প্রীত হয়ে ওঠেন। বিপন্ন সময়ে কেন, নিরাপদ সময়েও যাতে মুসলিমরা পছন্দমতো খাবার খেতে না পারেন, তার জন্য অমুসলিমরা খুনোখুনি শুরু করেন।

নিউজ়িল্যান্ডকে একটিই কথা তাই বলার আছে। আমাদের বিশ্বে যোগ দেওয়ার জন্য— স্বাগত!

Terrorism Gunman Attack Christ Church Attack Brenton Tarrant
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy