Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

অরণ্যে রোদন

দুই ঘটনাতেই প্রাথমিক প্রশ্নটি সুরক্ষার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তার বন্দোবস্ত সরকার দেখিলেও ব্যক্তিমানুষের আচরণ তাহারা কী করিয়া নিয়ন্ত্রণ করিবে?

স্কুল থেকে ফেরত পাওয়া লেগিংস হাতে ক্ষুব্ধ অভিভাবকেরা।

স্কুল থেকে ফেরত পাওয়া লেগিংস হাতে ক্ষুব্ধ অভিভাবকেরা।

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

অধুনা পশ্চিমবঙ্গের মূল ভাবধারাটি সম্ভবত ‘জোর যাহার মুলুক তাহার’। এই পর্বের ঘটনা দুইটি। এক, অতিরিক্ত শীতের কারণে ছাত্রীদের লেগিংস পরাইয়া স্কুলে পাঠাইয়াছিলেন অভিভাবকেরা, কিন্তু সেই পোশাক ইউনিফর্মে না থাকায় জোর করিয়া লেগিংস খুলাইয়া দিয়াছে কর্তৃপক্ষ। এবং দুই, পঞ্চাশ মিনিট বিলম্বে স্কুলে আসিবার কারণে প্রধান শিক্ষককে ছাত্রদের সম্মুখেই বিদ্যুতের খুঁটির সহিত বাঁধিয়া রাখিয়াছেন দুই গ্রামবাসী। শিক্ষক বা অভিভাবকই, দুই পক্ষ যেন অসহিষ্ণু ও কদর্য আচরণের প্রতিযোগিতায় নামিয়াছে। বুঝিয়া লইতে অসুবিধা হয় না, সার্বিক ভাবে সমাজের অবক্ষয় ঘটিয়াছে, যে স্থলে কেহ ভুল করিলে পাশবিক নির্যাতন করার ভিতরে চমকিত হইবার মতো কিছু নাই। কেবল অপরকে আক্রমণ করিবার জোর থাকিতে হইবে। শরীর এবং মনের জোর।

দুই ঘটনাতেই প্রাথমিক প্রশ্নটি সুরক্ষার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তার বন্দোবস্ত সরকার দেখিলেও ব্যক্তিমানুষের আচরণ তাহারা কী করিয়া নিয়ন্ত্রণ করিবে? নিরাপত্তা থাকিয়াও লাভ নাই, কেননা যে সুরক্ষাটির অভাব হইয়াছে, উহা সামাজিক। এই সমাজটি কী রূপ? ছাত্রীদের পোশাক খুলিয়া লওয়া বা শিক্ষককে পিছমোড়া করিয়া বাঁধিয়া অত্যাচার করা এক্ষণে স্বাভাবিকতায় পর্যবসিত হইয়াছে। সমাজতত্ত্বের ভাষায় যাহাকে নর্মালাইজ়েশন বলে, অর্থাৎ যে প্রক্রিয়ায় সামাজিক নীতির বাহিরে থাকা ভাবনা এবং আচরণ স্বাভাবিক হইয়া উঠে, তাহাই এই স্থলে ঘটিতেছে। স্বাভাবিকতার সংজ্ঞাটি বদলাইয়া গিয়াছে। দুই ক্ষেত্রেই আক্রান্ত পক্ষ যথাযথ প্রশ্ন তুলিয়াছে— শিশুদের স্বাস্থ্য-সম্মান অপেক্ষা কি পোশাক-বিধিই জরুরি, বা ছাত্রদের সম্মুখে মাস্টারমশাইকে এই রূপ অত্যাচার করিলে তাহার কী প্রভাব পড়িবে! বৃহত্তর সাধারণ বক্তব্যটি হইল, অপরাধ করিলে তাহার যে শাস্তি হইবে, উহাও বিধিবদ্ধ হওয়া শ্রেয়। স্কুলে ইউনিফর্ম মান্য না করা কিংবা দেরি করিয়া আসা শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধ, ইহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু অপরাধ যতই গুরুতর হউক, বলপ্রয়োগ করিয়া শিক্ষা দিবার পন্থাটি শতগুণ অধিক অপরাধ।

সামাজিক আশ্বাস এবং স্বাভাবিক বোধটির অভাব হইল কেন? প্রধানতম কারণ বর্তমান রাজনীতির ধরন। দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা যে আচার পালন করিয়া থাকেন, উহা বহুলাংশে সমগ্র সমাজের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। ইদানীং কালের পশ্চিমবঙ্গে কখনও নেতার দাপটে টেবিলের তলায় লুকাইয়াছে পুলিশ, কখনও আবার বিরোধী মতপোষণকারী ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করিয়া দিবার হুমকি দিয়াছেন নেতা। শাসক বা বিরোধী কোনও পক্ষই বেলাগাম আচরণে কম যায় নাই। রোলমডেলদের সেই ‘বীরত্ব’ যে চুইয়া জনতার ভিতরেও প্রবেশ করিবে, ইহা আর আশ্চর্য কী! কিন্তু অসংযমী নেতাগণকে অনুকরণ ও অনুসরণ করিবার পূর্বে জনতার এক বার আপনাদের ভবিষ্যৎ লইয়া ভাবিত হওয়া উচিত। যে নূতন মানদণ্ডে তাঁহারা স্বাভাবিকতাকে বাঁধিতেছেন, তাহাই যদি আগামী দিনে মান্য হয়, তাহা হইলে সমাজকে বাঁধিয়া রাখাই সঙ্কট হইবে। আগামী প্রজন্ম জানিবে, জোর থাকিলে যাহা-খুশি-তাহাই করিতে পারি। ইহাই দস্তুর। এবং, অবশ্যই, বিপরীত কথাটি শুনিবারও প্রয়োজন নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Humanity Society Social Security
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE