সাড়ে তিন দশকের রাজনৈতিক কেরিয়ারে তিন বার বরখাস্ত— ভাল রেকর্ড বলা চলে না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পাক সুপ্রিম কোর্টের আদেশে পদত্যাগ করিতে বাধ্য হইলেন। পানামাগেট মামলায় নাকি প্রমাণিত হইয়াছে যে, তাঁহার তিন ছেলেমেয়ের বিস্তর অঘোষিত সম্পত্তির কারণে তাঁহার পরিবার বিপুল পরিমাণে দুর্নীতিদুষ্ট। অনেক দিন ধরিয়াই শরিফের পিছনে দুর্নীতি অভিযোগ তাড়া করিয়া ফিরিতেছে। কিন্তু অভিযোগ ইত্যাদি এক কথা, আর সুপ্রিম কোর্টের হাতে এতখানি হেনস্তা আর এক কথা। অতঃপর শরিফের পক্ষে আর রাজনীতির মূলস্রোতে নেতা হিসাবে পা রাখাই কঠিন। তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী ইমরান খান স্বভাবতই খুশি। তিনি বা তাঁহার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দীর্ঘ অপেক্ষার পর রাজনৈতিক জয়ের স্বাদ পাইয়াছেন। আগামী বৎসরের মাঝামাঝি জাতীয় নির্বাচনে তাঁহার ভাগ্য পরীক্ষা। তিন দশক ধরিয়া প্রতিদ্বন্দ্বী শরিফ পাকিস্তানের রাজনৈতিক জমির অনেকটাই দখলে রাখিয়া আসিয়াছেন, আর ইমরান খান লাগাতার তাঁহার বিরোধিতা করিয়া যাইতেছেন। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে চূড়ান্ত পর্বে আনিয়া দিল।
নওয়াজ শরিফের পক্ষে ইহা যেমন দুঃসংবাদ, সম্ভবত তাঁহার দেশের পক্ষেও তেমন। অনেকে বলিতেছেন, এই ঘটনা পাকিস্তানের গণতন্ত্রের সুস্থতার পরিচায়ক, দুর্নীতির অভিযোগে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ গণতন্ত্রের সবলতার প্রতীক। মতটি উড়াইয়া দেওয়া চলে না ঠিকই, কিন্তু তাহা লইয়া প্রশ্ন থাকিয়া যায়। প্রথম প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠিলে ক্রিমিনাল ট্রায়াল পদ্ধতিতে মামলাটি চালানো হইল না কেন? কেন সরাসরি আদালতের আদেশে প্রধানমন্ত্রীর এমন আকস্মিক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত? কেন অন্যান্য অভিযুক্তদের বাদ দিয়া কেবল নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধেই রায়টি প্রদত্ত হইল? যে দেশে কর ফাঁকি দেওয়ার রেওয়াজ একটি প্রাতিষ্ঠানিকতায় পরিণত, প্রতিটি নেতা এবং উচ্চ শ্রেণির প্রায় সকল সদস্য যে দেশে নিয়মিত ভাবে কর ফাঁকি দিয়া থাকেন, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর এই আকস্মিক পরিণতি কি গণতন্ত্রের পক্ষে সুদৃষ্টান্ত? বিচারবিভাগের এহেন অতিসক্রিয়তার পর শাসনবিভাগের মাহাত্ম্য হ্রাস পাইবে না তো? পরবর্তী প্রশাসনিক প্রধান স্বাধীন ভাবে, বিচারবিভাগ বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের, বিশেষত সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের বাহিরে, দেশ শাসন করিতে পারিবেন তো? যে দেশে এক ধাক্কায় শাসনবিভাগকে এতটা দুর্বল করিয়া দেওয়া হয়, সেখানে অসামরিক সরকার যতক্ষণ না পর্যন্ত পূর্ণ মর্যাদা লইয়া ফিরিয়া আসিতেছে, ততক্ষণ গণতন্ত্রের মহত্ত্ব লইয়া নাচানাচি চলে না।
দ্বিতীয় প্রশ্ন প্রথমটির সহিত যুক্ত। শরিফ ২০১৩ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইয়াই বলিয়াছিলেন, অসামরিক ক্ষমতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠাই গণতন্ত্রের কাজ। বাস্তবিক, তিনি বরাবর অসামরিক ক্ষমতা বাড়াইবার পক্ষে, এবং সেই কারণে পাকিস্তানের অতি-শক্তিশালী সামরিক প্রতিষ্ঠানের অপ্রিয়ভাজন। বহু গোপনীয়তা সত্ত্বেও রাওয়ালপিন্ডির সহিত তাঁহার দীর্ঘ সংঘর্ষ গত কয়েক বৎসরে আন্তর্জাতিক মহল টের পাইয়াছে। ভারত-পাক সম্পর্ক লইয়াও শরিফ-সেনা দ্বিমত অগোচর থাকে নাই। পাকিস্তান জন্ম-ইস্তক গণতন্ত্র বনাম সামরিক স্বৈরতন্ত্রের লড়াই-শেষে সামরিক ক্ষমতার জয়ই দেখিয়াছে। প্রেসিডেন্ট মুশারফের মতো নেতাকেও এক কথায় সরাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। তাই প্রশ্ন ওঠে, সরাসরি সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দিন গিয়াছে, এখন কি বিচারবিভাগের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া সামরিক মহল ক্ষমতা জারি রাখিতেছে? সে ক্ষেত্রে বর্তমান মুহূর্ত পাকিস্তানের গণতন্ত্রের পক্ষে কেবল অনিশ্চয়তাময় নহে, তীব্র সংকটময়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy