তিনি শিল্পবান্ধব নন— ক্ষমতায় যখন এসেছিলেন, ভাবমূর্তিটা তখন অনেকটা এমনই ছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি রক্ষার যুদ্ধে নেমে নিজের রাজনৈতিক জমিটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শক্ত করে নিতে পেরেছিলেন ঠিকই। রাজ্যের মসনদ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার জন্য সেই কৃষক-দরদী ছবি যারপরনাই ফলপ্রসূও হয়েছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু ক্ষমতার অলিন্দে পা রেখেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝে গিয়েছিলেন, রাজ্যের শীর্ষ প্রশাসক হিসেবে সফল হওয়ার জন্য শুধু কৃষক-দরদী বা শুধু জমি আন্দোলনকারীর ভাবমূর্তি কাজে আসবে না। বিনিয়োগও আনতে হবে, কর্মসংস্থানও করতে হবে এবং তার জন্য শিল্পবান্ধব হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতেই হবে। চেষ্টা হয়তো হয়েছিল সেই লক্ষ্যে, কিন্তু চেষ্টা যে সফল হয়নি, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
শিল্প বা বাণিজ্যের প্রতি কোন রাজ্যের আনুকূল্য কতখানি, তার হিসেব কষতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, একাদশ স্থান থেকে পঞ্চদশে ছিটকে গিয়েছে বাংলা। অর্থাৎ শিল্পবান্ধব ভাবমূর্তির প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ আগের চেয়েও পিছু হঠেছে। এ রাজ্যে লগ্নি আকর্ষণের জন্য হইচই কিন্তু কম হয়নি। কখনও মুম্বই গিয়ে শিল্পপতিদের সম্মেলন ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী, কখনও কলকাতায় পুঁজিপতিদের সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা হয়েছে, কখনও আবার লগ্নি আনার লক্ষ্য নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সপার্ষদ ভিন্দেশে উড়ে গিয়েছেন। এত কিছু সত্ত্বেও লগ্নিকারীরা যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হতাশ করেছেন বাংলাকে, তা আজ বলাই বাহুল্য। কিন্তু কেন হতাশ করেছেন, তা আজ কিছুটা স্পষ্ট। পুঁজিপতিরা নিজেদের গন্তব্য হিসাবে বাংলাকে যে এখন আগের চেয়েও কম নম্বর দিচ্ছেন, তা ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ তালিকায় বাংলার অবনমন থেকেই পরিষ্কার।
গলদটা আসলে গোড়াতেই রয়ে গিয়েছে। লগ্নিকারীর জন্য ‘এক জানালা’ নীতি চালুর চেষ্টা করে বা পুঁজিপতিকে আপ্যায়ন করে শিল্প স্থাপনের প্রয়াস নিরন্তর চালিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কিন্তু এই গোটা চিত্রনাট্য মঞ্চস্থ হচ্ছে যে পটভূমিকার সামনে, সেই পটভূমিকা পুঁজির জন্য সুখকর নয় অনেক ক্ষেত্রেই। শিল্পের জন্য জমি নিতে গেলে রাজ্য সরকারের থেকে সব রকমের সহায়তা মেলে না এ রাজ্যে, চড়া দামে জমি কিনতে হয়। রেল প্রকল্প বা উন্নয়নী প্রকল্পও এ রাজ্যে আটকে থাকে সামান্য একটু জমিজটে। সরকারি প্রকল্প হোক বা বেসরকারি, রাজনৈতিক স্বার্থে বিন্দুমাত্র আঘাত লাগার আশঙ্কা থাকলেই রাজ্য সরকার সে প্রকল্প সম্পর্কে উত্সাহ হারিয়ে ফেলে।
এ হেন পটভূমিকা বা প্রেক্ষিত তৃণমূলের রাজনৈতিক উত্থানের ইতিহাস থেকেই জন্ম নিয়েছে। তাই বাংলায় বিনিয়োগের প্রশ্নে লগ্নিকারীর কপালে দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে ওঠা আশ্চর্য নয়। শুধুমাত্র বিশ্ব বাংলা বা গ্লোবাল বেঙ্গল স্লোগানে সেই দুশ্চিন্তার রেখা মুছে যায় না। রাজনৈতিক প্রশাসনের মানসিকতায় একটা মৌলিক পরিবর্তনের দরকার পড়ে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে সে কথাও এ বার বুঝতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy