নির্বাচনী প্রচারের মরসুম আরম্ভ হইতে না হইতেই ভারতের দখল লইয়াছে রাজনৈতিক নেতাদের অকথা-কুকথার স্রোত। কংগ্রেসের এক প্রার্থীর নামে মাসুদ শব্দটি দেখিয়া যোগী আদিত্যনাথ তাঁহাকে জইশ নেতা মাসুদ আজহারের জামাতা সম্বোধন করিলেন। নৃত্যশিল্পী স্বপ্না চৌধরির কংগ্রেসে যোগদানের সম্ভাব্য খবরে এক বিধায়কের মন্তব্য, রাজীব গাঁধী ইটালি হইতে নর্তকী সনিয়াকে বিবাহ করিয়া আনিয়াছিলেন, রাহুল গাঁধীও স্বপ্নাকে বিবাহ করিতে পারেন, শ্বশ্রূমাতা ও বধূ দিব্য মিলিয়া মিশিয়া থাকিবেন। প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা অযোধ্যায় যাইতেছেন শুনিয়া এক মন্ত্রী বলিলেন, প্রিয়ঙ্কা নির্ঘাত বাবরের অংশ খুঁজিতে আসিতেছেন! কেহ অন্য দলের নেতাদের তুলনা টানিতেছেন নেকড়ের পালের সহিত; কেহ বলিতেছেন, অমুক মানসিক রোগী। প্রধানমন্ত্রীই বা বাদ যাইবেন কেন, বিরোধী দলগুলির আদ্যক্ষর জুড়িয়া ‘শরাব’ শব্দটি আবিষ্কার করিয়া কটাক্ষ করিতেছেন। অপভাষার প্লাবনপঙ্কে সুস্বর ডুবিয়া মরিতেছে।
লক্ষণীয়, অধিকাংশ মন্তব্যই ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দের মুখনির্গত। ক্ষমতা একপ্রকার রক্ষাকবচ, তাহা থাকিলে যাহা ইচ্ছা বলিবার এক বিশেষ যোগ্যতা জন্মায়, যাহা বলিতেছি তাহা অপরের এবং নিজেরও মর্যাদাহানিকর কি না সেই বোধ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়। প্রতিপক্ষকে কদর্য আক্রমণের প্রবণতাও নূতন নহে। সুভাষচন্দ্র বসুকে ‘তোজোর কুকুর’ বলিয়াছিল যাহারা, তাহাদের কণ্ঠস্বর ছিল অকম্প্র। জমানা নির্বিশেষে শাসক বা বিরোধী দল একে অপরের নেতানেত্রীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গারেই ক্ষান্ত হয় নাই, কুরুচিকর দেওয়ালচিত্র ও স্লোগানে পরিপার্শ্ব ভরাইয়াছে, শারীরিক ত্রুটি পর্যন্ত ধরিয়া ব্যঙ্গ করিয়াছে। নেতা সর্বসমক্ষে অন্য দলের নেতার নামে গাল পাড়িলে হাততালির বন্যা বহিয়া যায়, চিত্রতারকা প্রার্থী হইলে সমাজমাধ্যমে অগণিত মানুষ তাঁহার বেশভূষা প্রসাধন নাড়িয়া ঘাঁটিয়া ক্রমশ চরিত্রের দিকেও আঙুল তুলিতে কালক্ষেপ করে না। এই সমস্তই প্রমাণ, জনমানসেও কুকথার গ্রহণযোগ্যতা আছে। সাধারণ মানুষ হরেদরে তাহা উপভোগ করেন। সমাজমাধ্যমে এই উপভোগের উৎসব কদর্যতর, কেন না সেই পরিসরে আক্রমণকারী ও আক্রান্ত কেহ কাহাকেও দেখিতে পাইতেছেন না, অদৃশ্য থাকিলে আক্রমণে সর্বৈব সুবিধা।
এই ধারাই কি নিরন্তর বহিয়া যাইবে? হয়তো নহে। চিত্রতারকার প্রার্থী হওয়ার ঘটনায় সমাজমাধ্যমে কাদা ছুড়িতেছিল যাহারা, তাহাদের বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি জানাইয়াছেন শিল্পী, বুদ্ধিজীবী-সহ বহু সাধারণ মানুষ, এমনকি কয়েক জন নেতাও। তাঁহাদের সৌজন্যেই এই চরম রাজনৈতিক তথা মানবিক অসৌজন্য কিঞ্চিৎ স্তিমিত হইয়াছে। যে দ্রুততায় কুবাতাস উঠিয়াছিল এবং প্রবল প্রতিবাদের পরে যে দ্রুততায় তাহা পড়িয়া গেল, তাহাতে সন্দেহ হয়— কুকথা বাগাইয়া আক্রমণটি ছিল পরিকল্পিত বন্দোবস্ত, এই শক্তিশালী প্রতিবাদ সেই সংগঠিত ইতরামির পালের হাওয়াটি কাড়িয়া লইয়াছে। অভিধানে ইতর অর্থে অশিক্ষিত, পামর, সাধারণ— বহু অর্থ উল্লিখিত। ইতরা নামের এক অনাদৃতা রাজমহিষীর পুত্রই দৈব আশীর্বাদধন্য হইয়া ঐতরেয় ব্রাহ্মণের ন্যায় শাস্ত্রগ্রন্থ লিখিয়াছিলেন। এই কালের নেতারা তাহা জানেন না, অথবা তাঁহারা আশীর্বাদযোগ্য নহেন বলিয়াই হয়তো তাঁহাদের যাত্রা ঐতরেয় নহে। সেই যাত্রাকে ‘ঐতরিক’ বলা চলে কি?