Advertisement
E-Paper

রাজনীতি তামাশা নয়

যাঁরা মাঠে নামেন তাঁরা এখনও, অন্তত সাধারণত, খেলাটাকে খেলা হিসেবেই নেন। সেটা কাণ্ডজ্ঞানের ব্যাপারও বটে— খেলার মধ্যে একটা স্বাভাবিক লড়াই থাকে, সর্বশক্তি এবং সমস্ত দক্ষতা দিয়ে সেই লড়াই লড়তে হয়, তাকে সত্যি সত্যি যুদ্ধ ভেবে বসলে খেলাটাই বরবাদ হয়ে যেত। কিন্তু খেলেন তো মাত্র ক’জন।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৭ ০০:০০

খেলায় রাজনীতির কোনও স্থান নেই, এমন একটা কথা এক কালে খুব শোনা যেত। সেই কালেও খেলার মধ্যে রাজনীতি ঢুকে পড়ত নিশ্চয়, তা না হলে কথাটা বলার দরকার হত না। আজ আর ওই আপ্তবাক্যটি বিশেষ শুনি না। তার কারণ এই নয় যে, খেলা থেকে রাজনীতি দূর হয়েছে। ব্যাপারটা উল্টো— খেলায় রাজনীতির আসন পাকাপোক্ত এবং স্বীকৃত হয়েছে। এবং সে খেলা যদি ভারত বনাম পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ হয়, তবে সেটি আর আসন নয়, সিংহাসন। সেই খেলায় রাজনীতি ঢুকে পড়ে না, ঢুকে পড়ার কোনও উপায় নেই, কারণ খেলাটাই রাজনীতি। যে রাজনীতির অন্য নাম: যুদ্ধ।

যাঁরা মাঠে নামেন তাঁরা এখনও, অন্তত সাধারণত, খেলাটাকে খেলা হিসেবেই নেন। সেটা কাণ্ডজ্ঞানের ব্যাপারও বটে— খেলার মধ্যে একটা স্বাভাবিক লড়াই থাকে, সর্বশক্তি এবং সমস্ত দক্ষতা দিয়ে সেই লড়াই লড়তে হয়, তাকে সত্যি সত্যি যুদ্ধ ভেবে বসলে খেলাটাই বরবাদ হয়ে যেত। কিন্তু খেলেন তো মাত্র ক’জন। বাকিদের কোনও দায় নেই, এমনকী খেলাটা মন দিয়ে দেখারও দায় নেই। এই বিপুলসংখ্যক দায়হীন, গর্বিত ভারতীয়ের একটা বৃহৎ থেকে বৃহত্তর অংশ ক্রমশই আপনবেগে পাগলপারা হয়ে উঠছেন, গালিগালাজে ও ব্যঙ্গবিদ্রূপে তাঁরা শত্রুদের নিপাত করবেনই করবেন, যারা সেই অশ্লীল কুনাট্যে শামিল হতে চায় না তাদের তৎক্ষণাৎ দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দেবেনই দেবেন। এই দেশপ্রেমী উন্মাদনা সোশ্যাল মিডিয়ার অনায়াস বাধাবন্ধহীন নিঃসীম পরিসরে সহস্রধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। সেই বিশ্বসাথে মিডিয়াযোগে বিহার না করেও রেহাই নেই, বন্ধুবান্ধব মণিমুক্তো সংগ্রহ করে ভালবেসে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, ‘লুঙ্গি’ আর জঙ্গি’র পরিশীলিত অন্ত্যমিল পড়ে চমৎকৃত হচ্ছি। মোদীর ভারত বলে কথা— ভয়ানক হুঙ্কার ও ভয়ানকতর গালিগালাজের প্লাবন এখন আর পাকিস্তানে গিয়ে থামছে না, বাংলাদেশের প্রতিও অকাতরে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। বুঝতে অসুবিধে হয় না, ক্রিকেট উপলক্ষমাত্র, এ হল অতিজাতীয়তার মৌতাত। নেশা যত চড়বে, আস্তিন-গোটানো রাজনীতি তত কায়েম হবে।

এ জিনিসের তাড়নায় খেলার কতটা ক্ষতি জানি না। খেলোয়াড়রা সুযোগ মতো খেলে যাচ্ছেন, যাবেনও। জয়পরাজয় চলছে, চলবেও। কিন্তু রাজনীতির— সত্যিকারের রাজনীতির— খুব বড় ক্ষতি হচ্ছে, আরও হবে। ক্রিকেট উপলক্ষে সম্পূর্ণ অন্তঃসারশূন্য নানান মন্তব্যের যে বিস্ফোরণ এবং তার মধ্যে সম্পূর্ণ বিচারবিবেচনাহীন জঙ্গিয়ানার যে প্রতিফলন, সেটাই অধুনা রাজনৈতিক সচেতনতা হিসেবে বাজারে কাটছে। খেলা আসে, খেলা যায়, ওই বাজারের শোরগোল চলতেই থাকে। চায়ের দোকানের আড্ডা কিংবা পত্রপত্রিকার পৃষ্ঠা অধুনা কিঞ্চিৎ নিষ্প্রভ, এখন রক্ত গরম করতে চাইলে সন্ধেবেলায় টেলিভিশন চ্যানেল আর অষ্টপ্রহর সোশ্যাল মিডিয়া। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সেই আসরে দু’দণ্ড স্থির হয়ে ভেবে কিছু বলার জো নেই, বিভিন্ন মতামত বিচার করে মধ্যবর্তী কোনও অবস্থান নেওয়ার উপায় নেই, হয় তুমি জাতীয়তাবাদী নচেৎ তুমি দেশদ্রোহী, হয় তুমি ভারতীয় সেনার প্রশ্নহীন ভক্ত নচেৎ তুমি দেশদ্রোহী, হয় তুমি পাকিস্তানকে শত্রু বলে মনে করো নচেৎ তুমি দেশদ্রোহী। এই বুদ্ধিহীন আত্মরতিকে আর যা-ই হোক, রাজনীতি বলে না।

অথচ রাজনীতির অনুশীলন এখন খুব দরকারি। পাকিস্তানের রাষ্ট্র, বিশেষ করে সামরিক বাহিনী ভারতের পক্ষে বাস্তবিকই বিপজ্জনক। এবং সে বিপদ দ্রুত বাড়ছে। এ বছর বরফ গলার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর অনুপ্রবেশ বেড়েছে, বিশেষত উরি সীমান্তে সংঘর্ষের মাত্রা এই মরশুমে অনেক বেশি। কিন্তু ছাতি ফুলিয়ে এই বিপদের মোকাবিলা করা যায় না, বরং তাতে জটিলতা বাড়ে। বাড়ছে। ‘পাথর ছুড়ছ কেন, বন্দুক হাতে নাও, এসো, লড়ে যাই’ আস্ফালন করতে গিয়ে কাশ্মীর উপত্যকার অভ্যন্তরীণ অস্থিরতায় যত ইন্ধন পড়ে, সীমান্ত-অতিক্রমী সন্ত্রাসের কারবারিদের ততই সুবিধে। কঠিন সত্য হল, পাকিস্তানের মহড়া নিতে মোদী সরকার দেশের অন্দরেই বেসামাল।

বাইরেও তথৈবচ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে মদত দেওয়ার ‘সাক্ষ্যপ্রমাণ’ নিয়ে বশংবদ সংবাদমাধ্যমে শোরগোল তোলা যায়, কিন্তু আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে ইসলামাবাদকে বেকায়দায় ফেলার লক্ষ্য পূরণে মোদী সরকার তিন বছরে এক পা-ও অগ্রসর হতে পারেনি। বিপরীত লক্ষণই বরং প্রকট। ট্রাম্পের ইচ্ছায় আফগানিস্তানে মার্কিন উপস্থিতি কমলে তালিবানের প্রতিপত্তি বাড়বে, সুতরাং পাকিস্তানেরও। অন্য দিকে, চিনের ছায়া দ্রুত গাঢ়তর হচ্ছে, এবং ইসলামাবাদ যে বেজিংয়ের ‘পরম বন্ধু’, সেটুকু সম্ভবত মোদীজিও জানেন। দিন কয়েক বাদে ট্রাম্পের করমর্দনের একটা সুযোগ তিনি পাবেন বটে, পাঞ্জায় হয়তো জিতেও যাবেন, তাঁর গায়ের জোর আছে, কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্টকে পাকিস্তান-শাসনে নামাতে পারবেন বলে ভরসা হয় না।

এই সংকটের মুহূর্তে একটা গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব ছিল উপমহাদেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা, সংকট মোকাবিলার সম্ভাব্য উপায়গুলি বিচার করা, জটিলতার গ্রন্থিগুলিকে খোলার চেষ্টা করা এবং, সবচেয়ে বড় কথা, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনী থেকে সেই দেশকে, তার সমাজকে, তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে স্বতন্ত্র করে চিনতে শেখা এবং শেখানো, সে দেশের নাগরিক সমাজের সঙ্গে সংযোগের সূত্রগুলিকে জোরদার করা। এই দায়িত্ব পালনেই রাজনৈতিক সচেতনতা শুরু হতে পারে। গণতন্ত্রে সেই চেতনার দাম অপরিসীম, বিশেষ করে শাসকরা যখন হাতের গুলি ফোলাতেই সদাব্যস্ত।

চেতনার বিকাশ চাইলে পরিশ্রম করতে হয়। মানসিক পরিশ্রম। ত্রিসন্ধ্যা জাতীয়তাবাদী চিৎকার কিংবা লুঙ্গি আর জঙ্গির অন্ত্যমিল, কোনওটাই সেই শ্রমের বিকল্প হতে পারে না। রাজনীতি তামাশা নয়।

Politics Sports Cricket ভারত পাকিস্তান
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy