Advertisement
E-Paper

যে ইতিহাস ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখায়

১৮১৭ সালে জন্ম নিয়েছিল হিন্দু কলেজ। পরে যা প্রেসিডেন্সি কলেজ, অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়। ধর্মতত্ত্বের গণ্ডি পেরিয়ে লিবারাল শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নির্মাণের চিন্তা ও সাহস উপনিবেশের মানুষ কী ভাবে পেয়েছিলেন? উত্তর সন্ধান করলে এ দেশে শিক্ষার বিবর্ণ ছবিটা শুধরোনোর পথও খুঁজে পেতে পারি। হিন্দু কলেজের দুশো বছর আসন্ন। এটাই ভাবার সময়।১৮১৭ সালে জন্ম নিয়েছিল হিন্দু কলেজ। পরে যা প্রেসিডেন্সি কলেজ, অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়। ধর্মতত্ত্বের গণ্ডি পেরিয়ে লিবারাল শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নির্মাণের চিন্তা ও সাহস উপনিবেশের মানুষ কী ভাবে পেয়েছিলেন? উত্তর সন্ধান করলে এ দেশে শিক্ষার বিবর্ণ ছবিটা শুধরোনোর পথও খুঁজে পেতে পারি। হিন্দু কলেজের দুশো বছর আসন্ন। এটাই ভাবার সময়।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৫ ০০:১৬

আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের প্রধান রূপকার এবং সে দেশের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন মনে করতেন, ১৮১৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া প্রতিষ্ঠাই সম্ভবত তাঁর জীবনের মহত্তম কীর্তি। যে যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ ছিল ধর্ম এবং নীতি বিষয়ক শিক্ষা দান, সেই সময়ে জেফারসন এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলেন, যার ঘোষিত উদ্দেশ্য হল নানা জাগতিক বিষয়ে এবং নাগরিক প্রশাসন ও পরিষেবার কাজে নেতাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, যেখানে রসায়ন ও গণিতের চর্চাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হল এবং যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা করে ধর্মশিক্ষার কোনও আয়োজনই রাখা হল না। তখনকার প্রচলিত রীতি মেনে চ্যাপেল নয়, গ্রন্থাগার হল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্র।

এটা আকস্মিক কিছু নয়: জেফারসন তাঁর এক বন্ধুকে লিখেছিলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে ধর্মতত্ত্ব (থিয়োলজি) পড়ানোর কোনও স্থান থাকা উচিত নয়।’ আধুনিক অর্থে যাকে ‘সেকিউলার’ বলে, জেফারসন ইউভিএ’কে সেই অর্থে একটি নিখাদ সেকিউলার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে তর্ক আছে, কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই যে, তিনি যা করেছিলেন সেটা ছিল তাঁর সময়ের নিরিখে একটা মৌলিক পরিবর্তন।

ইউভিএ’র জন্মের দু’বছর আগে, ১৮১৭ সালে, আট হাজার মাইল দূরের প্রাচ্যে একই ধরনের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছিল। যে শহরে সেটি প্রতিষ্ঠিত হল, তখনকার মানচিত্রে তার নাম ছিল ক্যালকাটা। আদিপর্বে টাকাটা এসেছিল শহরের সম্পন্ন দেশি নাগরিেকর কাছ থেকে, ডেভিড হেয়ার-এর মতো কিছু ব্রিটিশ সহমর্মীও তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল হিন্দু কলেজ— সেটা এই কারণে নয় যে সেখানে ধর্মশিক্ষার পরিকল্পনা ছিল, আসলে ‘হিন্দু কমিউনিটির সন্তানদের ‘লিবারাল’ শিক্ষা’ দানের উদ্দেশ্যেই এই কলেজের প্রতিষ্ঠা, তাই তার ওই নাম। সৌভাগ্যের কথা, কমিউনিটির ছাঁকনিটা অচিরেই হারিয়ে গেল: মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, নানা ধর্মের পড়ুয়ারা কলেজে প্রবেশাধিকার পেল এবং, আমি যত দূর জানি, হিন্দুধর্ম বা অন্য কোনও ধর্মই এখানে কখনও মূল পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এটা অস্বাভাবিক নয় যে, প্রতিষ্ঠানটির নাম পরে পালটে দেওয়া হয়, নতুন নাম হয় প্রেসিডেন্সি কলেজ। সম্প্রতি সে নিজেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত: প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি।

এই উদ্যোগে কতটা সাহসের পরিচয় ছিল, তা কল্পনা করা সহজ নয়। জেফারসন ছিলেন একটি উদীয়মান বিরাট রাষ্ট্রের বিরাট বড় নেতা, তাঁর দেশ তখন ঔপনিবেশিক প্রভুদের যুদ্ধে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জনের সাফল্যে বলীয়ান এবং উল্লসিত। অন্য দিকে, হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠাতারা তখন সবে এক নতুন ঔপনিবেশিক শক্তিকে মোকাবিলার প্রথম ধাক্কা সামলেছেন। মনে রাখতে হবে, নিজেদের উন্নততর সংস্কৃতির উত্‌কর্ষ নিয়ে সেই ঔপনিবেশিক শাসকদের গরিমার অন্ত ছিল না, এবং ভারতীয়দের প্রতি তাঁদের অবজ্ঞাও ছিল বিপুল। কলকাতার যে নাগরিকরা হিন্দু কলেজ নির্মাণে উদ্যোগী হন, তাঁরা ছিলেন নিজের দেশেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক এবং তাঁদের মোকাবিলা করতে হয়েছিল এমন একটি ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে, এই দেশে যাঁদের আধিপত্য তখন ক্রমশই বাড়ছে এবং সেই অনুপাতে তীব্রতর হচ্ছে ভারতীয়দের প্রতি তাঁদের প্রতিকূল মনোভাব। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে এই মানুষগুলো এমন প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কথা ভাবলেন কী করে? কোথা থেকে সংগ্রহ করলেন এমন এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়, তিন হাজার মাইলের মধ্যে যার তুল্য কিছু ছিল না? অক্সফোর্ড কেমব্রিজের কথা তাঁরা খুব সম্ভব জানতেন, কিন্তু যদি সেই দুই বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের প্রেরণা হয়ে থাকে, তবে বলতেই হবে, তাঁরা তাদের কোনও ভাবেই অনুকরণের কোনও চেষ্টা করেননি। মনে রাখতে হবে, অক্সফোর্ডে সে সময় গ্রিক, লাতিন এবং ধর্মতত্ত্বের পঠনপাঠনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত, আর হিন্দু কলেজে জোরটা পড়ল প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ইংরেজি ও বাংলায়। এই সাহসের উত্‌সটা কী ছিল?

ছাত্র এবং শিক্ষকরাও অনেকেই এই সাহসের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে বসে তাঁরা বিশ্বমানের গবেষণায় ব্রতী হন এবং সেই সাধনায় সফলও হন। জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের মতো কয়েক জনের নাম উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এমন অনেক পণ্ডিতের কথা আমরা ভাবতে পারি, প্রেসিডেন্সিতেই যাঁরা তাঁদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করেছেন।

সেই সাহস এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা আজ আমাদের খুব দরকার। এটা এখন সবাই জানেন যে, ভারত উচ্চশিক্ষায় এশিয়ার অন্য নানা দেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে। কিন্তু তার প্রতিকারের জন্য আমরা কী করছি? শিক্ষার যে আয়োজনটা দেশে চলে আসছে, সেটাকেই আরও বাড়িয়ে চলা ছাড়া আমরা আর কিছুই ভাবতে পারছি না। এ দিকে, শিক্ষার মান কিন্তু উত্তরোত্তর নেমে চলেছে।

অথচ আমাদের বিশেষ ভাবে ভাবা দরকার, উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিতে পঠনপাঠনের একটা সতেজ সজীব পরিবেশ কী ভাবে তৈরি করা যায়, এক সময় প্রেসিডেন্সি কলেজে যেমনটা ছিল। কিছু সুলক্ষণ দেখা যাচ্ছে— প্রতিভাবান গবেষকদের আকর্ষণ করার জন্য প্রেসিডেন্সিতে রাজ্য সরকার এবং ইনফোসিস ফাউন্ডেশন-এর আর্থিক সহযোগিতায় কিছু পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, শিব নাদার এবং অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নতুন প্রতিষ্ঠানগুলি লিবারাল আর্টস শিক্ষার ধারাটিকে ভারতের উপযোগী করে নতুন ভাবে প্রবাহিত করতে উদ্যোগী হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে একটা বিরাট প্রচেষ্টা আবশ্যক, অথচ সেটা কী ভাবে হবে, কে করবে, তা একেবারেই পরিষ্কার নয়।

ইতিহাসের এই উজ্জ্বল প্রগতিশীল মুহূর্তটাকে উদ্‌যাপন করা আমাদের একটা কর্তব্য। সেটা কেবল কলকাতাবাসী হিসেবে নয়, ভারতীয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ হিসেবেও (বাংলাদেশের এক জন প্রেসিডেন্ট এবং পাকিস্তানের এক জন প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্সির ছাত্র ছিলেন, যেমনটা ছিলেন আমাদের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ)। কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সৃষ্টিশীলতা এবং প্রত্যয়ের উদ্‌যাপন। নতুন কিছু, দারুণ কিছু গড়ে তোলার চেষ্টায় যে আশ্চর্য অনুভূতি, তার উদ্‌যাপন। ২০১৭ সালে হিন্দু কলেজের ২০০ বছর পূর্ণ হবে। লগ্ন আসন্ন। চলুন, এই সময়টিকে স্মরণীয় করে তোলার জন্য আমরা কিছু করি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অর্থনীতির শিক্ষক

hindu college 200 years presidency college post editorial abp post editorial abp latest post editorial avijit binayak bandyopadhyay Abhijit Banerjee Nobel Prize
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy